দুনিয়ার মুলা

দুনিয়ার মুলা

 দুনিয়ার মুলা

-এস হাবীব

 ‘গাধাকে মুলা দেখানো’ বলে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে। মানে গাধার মাথার মধ্যে কেউ একটা লাঠি দিয়ে মুলা ঝুলিয়ে রাখবে, আর সেই মুলা ধরার জন্য গাধা দৌড়াতে থাকবে, কিন্তু মুলার দেখা পাবে না। বাস্তব জীবনে দুনিয়া মানুষকে নানা ভাবে মুলা দেখায়। আর মানুষও গাধার মত ছুটতে থাকে, ‍কিন্তু দিন শেষে দ্বীন-দুনিয়া কোনটার দেখাই পায় না।

 হযরত ঈসা রূহুল্লাহ আলাইহিস সালামের একটি ঘটনা। তিনি একবার কোথাও যাওয়ার সময় দুনিয়াকে দেখতে পেলেন এক মহিলার ছূরতে। তার একটি হাত সামনে এবং আরেকটি হাত পিছনে। সামনের হাতটি রঙিন, চাকচিক্যময়। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে দুনিয়া! তোমার এই ছূরত কেন, তোমার একটি হাত সামনে এবং একটি হাত পিছনে? তোমার পিছনের হাতটি দেখাওতো। সে তার পিছনের হাতটি দেখালো। দেখা গেল, তার পিছনের হাতের মধ্যে একটা ছুরি, তা থেকে রক্ত ঝরছে। তিনি বললেন, এটার কি হাক্বীক্বত? দুনিয়া বললো, আমার সামনের যে হাতটি রঙিন, চাকচিক্যময়, এটা দিয়ে আমি মানুষকে ধোঁকা দেই, এর রঙিন, চাকচিক্যময় দেখে মানুষ দুনিয়ার মোহে মোহগ্রস্ত হয়ে দুনিয়াতে গরক হয়ে যায়। আর পিছনের যে হাতটি দেখছেন, তাতে ছুরি রয়েছে, রক্ত ঝরছে, আমি সেই হাতটি দিয়ে তাকে দুনিয়ায় মোহগ্রস্ত করে হত্যা করে ফেলি অর্থাৎ দুনিয়ার মোহের মধ্যে রেখে তাকে মৃত্যু পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেই। ফলে দুনিয়ার মোহ নিয়ে সে মৃত্যুবরণ করে জাহান্নামে চলে যায়। নাউযুবিল্লাহ!

 বাস্তব জীবনে আমরা দেখি দুনিয়ার ‍মুলা দেখে অনেকেই সারা জীবনে ছুটতে থাকে। কিন্তু দুনিয়ার দেখা আর পায় না। কিন্তু দুনিয়ার পেছনে ছুটতে ছুটতে তার পরকালও বরবাদ হয়ে যায়।

 উদাহরণ দিলে বুঝতে সহজ হবে। যেমন-

 বাংলাদেশের অনেক তরুণ এখন ইউরোপ-আমেরিকা-কানাডা যেতে চায়। তাদের ধারণা কাফিরের দেশে গেলেই বোধ হয় ভালো থাকা যাবে। সেই মুলার পেছনে সে ছুটতে থাকে। প্রচুর টাকা খরচ করে, পরিশ্রম করে, কষ্ট করে, কিন্তু কাফিরের দেশের মুলা আর তাকে ধরা দেয় না। দেখা যায়, বাংলাদেশে যে ছেলে একা এক রুমে থাকতো, বিদেশে গিয়ে সে ৫-১০ জন এক রুমে গাদাগাদি করে থাকে। বাংলাদেশে যে ছেলে অলসতায় দিন কাটাতো, ইউারোপ-আমেরিকায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়, তারপরও জীবন নির্বাহ কঠিন হয়ে যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে বিদেশের মুলা যত সহজ মনে হয়েছে, বাস্তবে তা তত সহজ না, বরং অনেক কঠিন। হিসেব করে দেখা যায়, যে টাকা খরচ করে বিদেশে যাওয়া হয়েছে এবং সেখানে যে পরিশ্রম হচ্ছে, সেই অর্থ ও পরিশ্রম যদি বাংলাদেশে কেউ করতে পারতো, তবে দেশেই অনেক ভালো থাকতে পারতো।

 শুধু বিদেশ কেন, দেশের মধ্যেও দুনিয়ার মুলার ঘাটতি নেই। অনেকে আছে, যারা দ্বীন ভুলে সারা দিন শুধু দুনিয়া, আর দুনিয়া। ভালো স্কুল-কলেজ, ভালো ভার্সিটি, ভালো চাকুরী, ভালো গাড়ি, ভালো বাড়ি, ভালো কারিয়ারের চিন্তা সারাদিন। হালাল-হারাম ভুলে শুধু টাকার বস্তা কামানোর চিন্তা। দ্বীনের জন্য, পরকালের জন্য চিন্তা করার নূন্যতম ফুসরত নেই। এরকম করতে করতে এক সময় বয়স বাড়তে থাকে। এক সময় মৃত্যুর ডাক চলে আসে, জীবন প্রদীপটা ঢুশ করে নিভে যায়।

 আমার এক পরিচিত ছেলে ছিলো। বয়সে আমার থেকে ৮-১০ বছরের ছোট। তাকে দেখা হলেই বলতাম, তোমাকে তো দ্বীনি কাজে দেখি না। কোথায় থাকো? উত্তরে সে বলতো- ভাই, খালি একটা সরকারী চাকুরী পাই, তারপর দেখবেন দ্বীনি কাজে কিভাবে সময় দেয়। হঠাৎ একদিন খবর পেলাম, ছেলেটা পানিতে ডুবে মারা গেছে। আফসুস লাগলো, আহারে ছেলেটা সরকারী চাকুরীও পেলো না, আর দ্বীনি কাজেও সময় দিতে পারলো না, তার আগেই পরপারে চলে গেলো।

 আমি লক্ষ্য করেছি, আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোও দুনিয়াদার কম নয়। তারা নিজেও দ্বীনের কাজ করে না, আবার দ্বীনি কাজে ব্যস্ত কাউকে দেখলে তাকে কিভাবে বাধা দেয়া যায়, তাকেও কিভাবে দুনিয়াদার বানানো যায়, সেই চেষ্টা করে। আমার নিজের কথাই বলি, তরুণ বয়স থেকে চেষ্টা করতাম নিজে দ্বীনের রাস্তায় থাকার এবং অন্যদের সেই রাস্তায় আনতে। কিন্তু সেই কাজে নানানভাবে বাধা এসেছে। একদিন আমি এক চাচার বাসায় কোন কাজে যাই। সেই চাচা আমাকে দেখে বলবো, “আরে তুমি এগুলো কি করো? এগুলো বাদ দাও। এসব দাড়ি-টুপি ছাড়ো। আমার কাছে আসো। আমি তোমাকে চাকুরী দিবো। অনেক টাকা দিবো। তোমাকে ভালো দেখে বিয়ে করায় দিবো। অনেক কিছুর মালিক হবে।”

 একই আশ্বাস আমার আরো দুই আত্মীয় আমাকে দিয়েছিলো। বলেছিলো, এসব দ্বীনি কাজ বাদ দাও। এগুলো করলে ক্যারিয়ার হবে না। আগে ক্যারিয়ার গঠন করো। টাকা পয়সা কামাও, সবাই তোমার কথা শুনবে।

 আমি আমার সেই তিনজন পরিচিতকে খুব ভালো করেই চিনতাম। তাদের ব্যবসায়ীক কাজে বিশ্বস্ত কর্মচারি দরকার ছিলো। আর তারা নিজেদের প্রয়োজনে আমাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো। অর্থাৎ নিজের প্রয়োজনের জন্য তারা আমাকে দ্বীনের রাস্তা থেকে ফেরাতে চেয়েছিলো, দুনিয়ার মুলা দেখিয়েছিলো। আমি এও জানতাম, এই লোকগুলো আমাকে কিছুদিন ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিলের পর ছুড়ে ফেলবে, মানে আমার দ্বীন-দুনিয়া দুটোই তখন যাবে। তাই আমি তাদের দুনিয়ার মুলার ফাঁদে পা দেই নি।

 আমি বিশ্বাস করি, সেই সময় মহান আল্লাহ পাক খাস রহমত করে আমাকে হেফাজত করেছেন। কিন্তু অনেক ছেলে-মেয়ে আছে, এ সমস্ত দুনিয়ার মুলা দেখে ধোঁকা খায়। দ্বীনকে ভুলে দুনিয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু দিন শেষে- “না পায় দ্বীন, না পায় দুনিয়া”, হারায় দুটোই।

 আবার, মহান আল্লাহ পাক মানুষকে হালাল রিজিক তালাশ করতে বলেছেন, কিন্তু সেই তালাশ করতে গিয়ে আল্লাহ পাককে ভুলে যেতে বলেননি। কিন্তু দেখা যায়, মানুষ এমনভাবে রিজিক তালাশে ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, তাকে দ্বীনি কোন কাজেই পাওয়া যায় না। খোঁজ নিলে দেখা যায়, এ সমস্ত লোকগুলো অযথাই দুনিয়ার মুলার পেছনে ঘুরে ঘুরে সময়টা শেষ করছে, কিন্তু বাস্তবে তাদের কাছে দুনিয়া ধরা দিচ্ছে না। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “হে আদম সন্তান, আমার (আল্লাহ পাক উনার) ইবাদতের জন্য তুমি নিজের অবসর সময় তৈরী কর ও ইবাদতে মন দাও, তাহলে আমি তোমার অন্তরকে প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দেব এবং তোমার দারিদ্র ঘুচিয়ে দেব। আর যদি তা না কর, তবে তোমার হাতকে ব্যস্ততায় ভরে দেব এবং তোমার অভাব কখনোই দূর করব না।" [তিরমিযী : ২৬৫৪; ইবন মাজাহ : ৪১০৭]

 দেখা যায়, বর্তমান স্যোশাল মিডিয়ার যুগে দুনিয়ার মোহ আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। মানুষ কিছু একটা কিনলে, খেলে, ঘুরতে গেলেই সেটা নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়। এরকম হাজার হাজার স্ট্যাটাস দেখে অন্যদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। তাদের মত ধন-সম্পদ ও আরাম-আয়েশ ও নফসের চাহিদা মেটাতে আরো উন্মত্ত হয়ে যায়, দ্বীন ভুলে আরো দুনিয়াদার হয়। অথচ যে লোকটার দুনিয়ারী দেখে আমরা আকৃষ্ট হচ্ছি, তার দ্বীনদ্বারী বা আমল-আখলাক দেখলে বুঝা যায়, দুনিয়ার মানুষগুলো পরকালের পাথেয় অর্জনে কতটা সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আছে।

 এজন্য আমরা দুনিয়ার মুলা দেখে যেন বিভ্রান্ত যেন না হই, সেই খেয়াল রাখতে হবে। দুনিয়া থেকে দ্বীনকে প্রাধান্য দিতে হবে। তবেই মহান আল্লাহ পাক অবশ্যই আমাদের দ্বীন-দুনিয়া দুটোইকে হেফাজত করবেন ইনশাআল্লাহ।