ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধারা তুফানুল আকসার মাধ্যমে যে ভূ-রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করলেন
লেখক- মুহম্মদ ইনজামামুল
চলমান ফিলিস্তিন ইসরাইল যুদ্ধে ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সামরিক সফলতা রয়েছে। তবে সামরিক সফলতার থেকে বেশি সফলতা এসেছে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। আজকের আলোচনা সে বিষয় নিয়েই।
মূলতঃ আন্তর্জাতিকভাবেই ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুটা সবসময় একটা স্বীকৃতির যুদ্ধ ছিল। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময় যখন পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত ছিল, ইস্টার্ন ব্লক এবং ওয়েস্টার্ন ব্লক। ইস্টার্ন ব্লক বা রুশ-চীন বলয়ের দেশগুলো সে সময় ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে সম্মত ছিলো না। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সে সময় ছিল ইসরাইল বিরোধীদের ঘাঁটি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সরকারের রদ বদলের মাধ্যমে অনেক দেশ-ই ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা শুরু করে। তবে যে সব সরকার ইসরাইল বিরোধীতা করতো, সেই সরকারগুলির বিরুদ্ধেই আমরা দেখেছি ইসরাইল তাদের সামরিক এবং প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতো। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনপন্থী সরকারগুলোকে দুর্বল করে ইসরাইলপন্থী বা ইজরাইলের ব্যাপারে দুর্বল এরকম সরকারগুলোকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা। এখনও ওই অঞ্চলগুলোর বামপন্থীদের মধ্যে ইসরাইল বিরোধিতা খুব প্রকট আকারে দেখা যায়। যেমন- বর্তমানে বলিভিয়া, চিলি বা কলোম্বিয়ার মধ্যে লক্ষণীয়।
এ অঞ্চলগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার পর পৃথিবীতে ইসরাইল বিরোধী দেশগুলোর মধ্যে অবশিষ্ট থাকে মুসলিম বিশ্ব। তাই আমরা দেখি ২০২০ সালে আব্রাহাম একর্ড চুক্তির মাধ্যমে মুসলিম দুনিয়াতেও ইসরাইল নিজের স্থান পাকাপোক্ত করে নিতে শুরু করে।
স্বাভাবিকভাবেই অনেকের মধ্যে প্রশ্ন থাকতে পারে ইসরাইল স্বীকৃতির জন্য কান্নাকাটি করে লাভ কি? ইসরাইলকে তো আর কেউ পরাজিত করতে পারছে না, ওরা নিজেরাই তো এমনিতেই ক্ষমতাশীল দেশ ওদের স্বীকৃতির প্রয়োজন হওয়ার কথা না।
কথাটা আংশিকভাবে সত্য হলেও পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ ইসরাইলের স্বীকৃতির মধ্যেই ফিলিস্তিনের অস্বীকৃতি লুকিয়ে আছে।
১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের ১৮১ নাম্বার রেজুলেশন অনুযায়ী, ফিলিস্তিন নামক দেশকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয় এক ভাগ দেওয়া হয় বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইহুদি দখলদারদেরকে এবং অন্যান্য দেওয়া হয় ভূমিপুত্র আরব বা ফিলিস্তিনিদের। ১৯৪৭ এর সেই রেজুলেশন কে মেনে নিয়ে ইহুদীরা ওদের জন্য বরাদ্দকৃত ভূমিতে একটি রাষ্ট্র স্থাপন করে ফেলে, কিন্তু আরব ফিলিস্তিনিরা কিছু করে না। যেহেতু জাতিসংঘের পরামর্শে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটি ইহুদিরা প্রতিষ্ঠিত করে সেহেতু জাতিসংঘের অনেক সদস্য রাষ্ট্রই তাৎক্ষণিক ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে দেয় যাদের মধ্যে মূলত পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু অপরদিকে ফিলিস্তিনিরা তো কোন রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠিত করেনি তাই ফিলিস্তিনিদেরকে আলাদা করে স্বীকৃতি দেওয়ারও কিছু ছিল না।
এরপরে ১৯৬৭ তে ইসরায়েলী দখলদাররা আরবদের উপর ব্যাপক হামলা চালায়। মাত্র ছয় দিনের মধ্যে ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনকে তো দখল করেই সাথে সাথে আশেপাশের আরব দেশগুলোর থেকে ভূমি দখল করতে সফল হয়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরাইলকে হাঁটিয়ে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর থেকে উপকূল পর্যন্ত ফিলিস্তিন নামক যে রাষ্ট্র কায়েম করার স্বপ্ন আরবদের ছিল তা হয়ে যায় একটি রূপকথার গল্পের মতন।
১৯৯৩ সালে ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত অনেকটা নিরুপায় হয়ে দখলদার ইসরাইলি প্রাইম মিনিস্টার রাবিনের সাথে চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী ইসরাইল ১৯৬৭-র আগের সীমানায় ফেরত চলে যাবে এবং পশ্চিম তীর এবং গাজা এই দুই অঞ্চলে ফিলিস্তিন নামে একটি রাষ্ট্র কায়েম করতে দিবে ফিলিস্তিনিদের। এটা কে বলা হয় টু স্টেট সলিউশন। কিন্তু কেন কিসের বিনিময় দখলকৃত ভূমি ফিলিস্তিনিদের কাছে ফিরিয়ে দিবে ইসরাইলিরা? সে অমূল্য ধন হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের দেওয়া ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের উপর স্বীকৃতি। হ্যাঁ ইসরায়েলিদের কাছে স্বীকৃতি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মনে রাখতে হবে ইসরাইলিরা এই ভূমির দখলদার, ভূমিপুত্র না। দখলদাররা স্বীকৃতির জন্য মরিয়া হবে এটাই স্বাভাবিক।
প্রশ্ন করা যায়, চুক্তি করার পরেও ফিলিস্তিন নামে রাষ্ট্র কেন কায়েম হলো না? এর কারণ হলো, চুক্তির পর পরই ফিলিস্তিনি এবং ইহুদিদের মধ্যে দুইটা দলে বিভক্ত দেখা যায়। ইহুদিদের মধ্যে একটি দল পশ্চিম তীর এবং গাজা ফিলিস্তিনিদের হাতে ছেড়ে দিতে নারাজ হয়ে যায় এবং দুই বছর পরেই তারা তাদের প্রাইম মিনিস্টার রবিনকে হত্যা করে। এবং এই সময়টাতেই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হামাসের উত্থান হয় যারা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ এবং গোটা ফিলিস্তিনে ইসরাইলদেরকে বিতাড়িত করে ফিলিস্তিন কায়েম করার পক্ষে।
১৯৯৮ সালে ক্ষমতায় আসে চুক্তি বিরোধী প্রাইম মিনিস্টার বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ক্ষমতা আসার সাথে সাথেই পশ্চিম তীর থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয় নেতানিয়াহু। এ থেকে থমকে যায় ফিলিস্তিন নামে স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করার প্রচেষ্টা।
এর মধ্যেই আমরা দেখতে থাকি যে, আস্তে আস্তে মুসলিম দেশগুলোও ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরোক্কো সবাই স্বীকৃতি দিতে থাকে। যে স্বীকৃতির দেওয়ার শর্তে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করার প্রতিশ্রুতি দেয় ইসরাইল, সেই স্বীকৃতি ফিলিস্তিন কায়েম না করেই ইসরায়েলীরা পেয়ে যাচ্ছিলো, এটা নেতানিয়াহু এবং দখলদার ইসরাইলিদের জন্য বিজয়। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা না দিয়েই ইসরাইলিদের ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের উপর দখলকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে দখলদারিত্বকে বৈধতা দেওয়া। এই বৈধতা পেলে ফিলিস্তিন নামের কোন স্বাধীন দেশ আর কায়েম হবে না এবং ইসরাইলকে আর অবৈধও বলা যাবেনা।
তাই ৭ই অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে শুরু হওয়া তুফান আল আকসা অভিযান ফিলিস্তিন স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে রচিত হয়ে থাকবে। কারণ আমরা দেখেছি এই অভিযানের শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে সৌদি আরব এবং ইসরাইলের মধ্যে বৈঠক চলছিল, এই যুদ্ধের কারণেই সৌদি আরব বাধ্য হয় বৈঠক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক থেকে দূরে সরে আসতে। সৌদি আরবের মতন একটি প্রভাবশালী দেশ যদি ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিত তাহলে পৃথিবীর সকল মুসলিম দেশের সরকার মার্কিন কূটনৈতিক চাপের শিকার হয়ে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করতো। যা বড় বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আনতো ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য, আর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রাম ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে যেত। ফিলিস্তিনিদের তিলে দিলে হত্যা অথবা বিতাড়িত করে দেওয়া হতো তাদের ভূমি থেকে, পশ্চিম তীর এবং গাজা থেকে বিলীন হয়ে যেত ফিলিস্তিনিরা। ভেঙে ফেলা হতো আমাদের প্রাণের মসজিদুল আকসা কে। তাই সাময়িকভাবে হলেও সৌদি আরবসহ মুসলিমদেশগুলোকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানে বিরত রাখতে পারা ফিলিস্তিনি মুক্তিকামীদের জন্য বিরাট সাফল্য।