খেলাধূলার অপর নাম নিষ্ঠুর অমানবিকতা

খেলাধূলার অপর নাম নিষ্ঠুর অমানবিকতা

  খেলাধূলার অপর নাম নিষ্ঠুর অমানবিকতা

-মুহম্মদ মুহিউদ্দিন রাহাত

 ছোটবেলায় প্রাচীন রোমান সম্রাজ্যের গ্ল্যাডিয়েটরদের গল্প ‍শুনতাম। গ্ল্যাডিয়েটর হওয়ার জন্য বেছে নেয়া হতো ক্রীতদাস, বন্দী ও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে। ময়দানে তাদের হিংস্র পশুর সাথে ছেড়ে দেয়া হতো। গ্ল্যাডিয়েটর আর হিংস্র পশুর বাঁচা-মরার লড়াই চতুর্পাশ থেকে দর্শক ও রোমান শাসকরা বিনোদন হিসেবে উপভোগ করতো। তারা আনন্দ করতো, চিৎকার করতো। দর্শকদের জন্য সেই লড়াই আনন্দের হলেও গ্লাডিয়েটরদের জন্য তা মোটেও আনন্দের ছিলো না।

 আধুনিক যুগে কিছু বহুল প্রচলিত খেলাধূলা আমাকে গ্ল্যাডিয়েটরদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমন- ক্রিকেট খেলা, যেখানে একজন বোলার বল করে, বাউন্স দেয় ব্যাটারের মাথা, বুক, পেটকে টার্গেট করে। ব্যাটার কোন মতে সেই বাউন্স থেকে মাথা বাঁচায়। আবার কেউ বাউন্স থেকে মাথা বাঁচাতে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। আবার কারো মাথায় বাউন্স লেগে মৃত্যুও হয়। অথচ এই নিষ্ঠুর অমানুষিক দৃশ্য দেখে দর্শকরা হৈ হুল্লা করে, বিনোদন পায়। কেউ ইনজুরিতে পা ভাঙ্গে, কারো হাত ভাঙ্গে, কারো হাঁটুতে, কারো কাঁধে অস্ত্রোপচার। কেউ ব্যাথায় চিৎকার করে, কেউ অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, কেউ ভাঙ্গা-সেলাই করা হাত নিয়ে ব্যাটিং-বোলিং করে। কিন্তু দর্শকের সেই কষ্টের দৃশ্য দেখে মন গলে না। তারা চায় তার পছন্দের ব্যাটার বোলার যত অসুস্থই হোক, সে খেলুক, তাকে বিনোদন দিক, সে আনন্দে উদ্বেলিত হোক। খেলোয়ারের শারীরিক কষ্টের থেকে তার বিনোদনের গুরুত্ব তখন অনেক বেশি, ঠিক যেমনটা প্রাচীন রোমে গ্ল্যাডিয়েটরদের বেলায় দেখা যেতো।

 ফুটবল খেলার অবস্থা তো আরো করুণ। কত ফুটবলার যে খেলার সময় হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করে কিংবা হাত-পা ভেঙ্গে শুয়ে থাকে তার ইয়ত্তা নেই। ফাউল করে প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে ইনজুরি ফেলানো যেন খেলারই অনুষঙ্গ।

 আরেকটা খেলা নতুন দেখছি, স্ল্যাপ ফাইটিং। কি জঘন্য। একজন অন্যজনের মুখে চড় মেড়ে মুখের গড়ন ভচকে দিচ্ছে, আর সেটা দেখে মানুষ হৈ হুল্লো করছে, আনন্দ পাচ্ছে, ছিঃ। কি নিকৃষ্ট।

 স্পেনের জাতীয় খেলার নাম ষাঁড়ের লড়াই বা বুল ফাইট। মেক্সিকোতেও এ খেলার প্রচলন আছে। এ খেলায় মানুষ ষাঁড়কে ক্ষেপিয়ে তোলে। এরপর ক্ষ্যাপা ষাঁড়টা লম্বা শিং নিয়ে ঐ লোককে তাড়া করে। কখনো মানুষটি নিজেকে রক্ষা করতে পারে, আবার কখনো ষাঁড়ের শিং এর হিংস্র গুতা খায়। কখনও মানুষটিকে শক্তিশালী ষাঁড় পায়ের নিচে ফেলে দলিত মলিত করে। ষাঁড়ের সাথে এ ধরনের লড়াইয়ে মানুষটির মৃত্যুও হতে পারে। তারপরও দর্শকরা এ নিষ্ঠুর লড়াই দেখে আনন্দ পায়। শুনেছি, কিছু কিছু এলাকায় বুল ফাইট নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এ নিষিদ্ধ করার পেছনে কাজ করেছে প্রাণী অধিকার কর্মীরা। তাদের দাবী এ খেলায় পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা করা হয়। আমার কাছে বিষয়টি অবাক লেগেছে, কারণ- প্রাণী অধিকার কর্মীরা প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা নিয়ে কথা বলে, কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা নিয়ে কথা বলে না, কারণ এর মাধ্যমে নাকি মানুষ বিনোদন পায়!

 আসলে আমরা সব সময় মানবতার কথা বলি, নিষ্ঠুরতা-সহিংসতা এড়িয়ে চলতে বলি। কিন্তু এ নীতিবাক্যগুলো জীবনের সকল সেক্টরে অ্যাপ্লাই হলেও খেলোধূলার সময় আমরা সে কথা ভুলে যাই। নৃসংশতা, নিষ্ঠুরতা, সহিংসতা, বিপরীত পক্ষকে আঘাত করা আমাদের কাছে তখন স্বাভাবিক মনে হয়, সেগুলো দেখেই আমরা আনন্দিত হই, বিনোদন নেয়ার চেষ্টা করি। মুখে বলি খেলাধূলা মানুষকে নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা, উগ্রতা, অমানবিকতা থেকে দূরে রাখে, কিন্তু বাস্তবে খেলাই যে মানুষকে নিষ্ঠুর, হিংস্র, উগ্র ও অমানবিক করে তুলে তার উজ্জল উদাহরণ দেখা যায়। শুধুমাত্র অর্থের বিনিময়ে কেউ নৃশংসতা বরণ করে নিবে আর কেউ সেটা দেখে বিনোদিত হবে, এটা কখন সভ্য মানুষের লক্ষণ নয়।

Comments