অর্থনৈতিক মন্দা : সমাধান বিদেশী বাদ দিয়ে দেশী পণ্য ব্যবহার করা
করোনার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক মন্দাভাব দেখা দেয়। এর কারণ করোনার সময় লকডাউন দিয়ে বিভিন্ন দেশের উৎপাদন সেক্টর বন্ধ রাখা হয়েছিলো। এছাড়া কোভিড টীকার পেছনেও খরচ করা হয়েছে প্রচুর। এতে করোনা শেষ হতেই সেই প্রভাব পড়তে শুরু করে, সবকিছুর দাম হু হু করে বেড়ে যায়। এরপর শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে বিশ্বজুড়ে বেড়ে যায় জ্বালানির দাম। সেই স্রোতে বাড়তে থাকে সব কিছুর দাম। বর্তমানে ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাত চলমান। খুব সহসাই এ যুদ্ধ বন্ধের আভাস নেই। বরং যুদ্ধে অনেক দেশের জড়িয়ে পরার আশঙ্কা আছে। এরই মধ্যে সুয়েজ খালে পণ্য পরিবহনে বাধা আসছে। অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়বে অবশ্যই। পরিস্থিতি দিনে দিনে আরো কঠিন হতে পারে, কারণ ইসরাইলের সাথে আমেরিকার একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান। ইসরাইল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মানে আমেরিকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। তাই ইসরাইলকে বাঁচাতে মরণপন চেষ্টা করবে আমেরিকা। ইউক্রেনকে যেমন আমেরিকা আর্থিক সহায়তা করেছে, ঠিক তেমনি ইসরাইলকেও সে ব্যাপক আর্থিক সহায়তা করবে। তবে এসব খরচের ভার আমেরিকা কখনই নিজের উপর রাখবে না। যেহেতু তার ডলার আন্তর্জাতিক মুদ্রা, তাই সে ডলারের দাম বাড়িয়ে যুদ্ধ খরচ সারা বিশ্ব থেকে তুলে নিবে। বাংলাদেশের রিজার্ভও যেহেতু ডলারে। সুতরাং ডলারের দাম বাড়লে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এবং ডলারের মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব আমাদের দেশীয় অর্থনীতি পড়বে এবং স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য আরো বাড়বে। এমনিতেই বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির চরম শিখরে অবস্থান করছে, এর মধ্যে ডলারের দাম আরো বাড়লে তার ধাক্কা বাংলাদেশে কেমন লাগবে, তা সত্যিই চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশের জনগণ মনে করে, যুদ্ধ হয় অনেক দূরে, বাংলাদেশে এর প্রভাব কিভাবে আসে? আসলে যুদ্ধ যতই দূরে হোক, ডলার যেহেতু আন্তর্জাতিক মুদ্রা, তাই সেই মুদ্রা ব্যবহার করলে যুদ্ধ যত দূরে হোক, এর প্রভাব বাংলাদেশে আসবেই।
এবার আসি বাংলাদেশ নিয়ে। দেশে নির্বাচন শেষ। স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনের আগে সরকার সবকিছুকে স্থিতিশীল রাখতে চায়। এজন্য ভর্তুকি দিয়ে হলেও জনগণের কাছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করে। কিন্তু নির্বাচন চলে গেলে পরিস্থিতি ঢিলে ঢালা হওয়া স্বাভাবিক। অনেক স্থানে ভতুর্কি না পড়লে অর্থনীতির মন্দাভাব আর দৃঢ়মান হয়ে উঠতে পারে।
লক্ষ্য করে দেখবেন, খোদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সামনের অর্থনীতি নিয়ে খুব একটা আশার কথা শোনায়নি। তিনি ইতিমধ্যে তার স্বভাবসিদ্ধ রাজনৈতিক ভাষায় বলেই ফেলেছেন, “২০২৪ সালের মার্চে দেশে ‘দুর্ভিক্ষ ঘটানোর’ দেশী-বিদেশী পরিকল্পনা রয়েছে।” (তথ্যসূত্র: বণিক বার্তা, ডিসেম্বর ০৯, ২০২৩)
আসলে দেশী-বিদেশীরা যত ষড়যন্ত্র করুক, আন্তর্জাতিক যত যুদ্ধ বিগ্রহ লাগুক, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন নিয়ে কোন সমস্যা নেই। কারণ বাংলাদেশে অনেক কিছুই পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। সমস্যা হচ্ছে শুধু বিদেশ থেকে আমদানি নিয়ে। কারণ দেশের সীমানার বাইরে আমদানি করতে গেলেই ডলারের প্রয়োজন হয়, আর ডলারের ব্যবহার মানেই আমেরিকার মূল্যস্ফীতি টেনে দেশে নিয়ে আসা। এক্ষেত্রে সমাধান হতে পারতো, ডলারের ব্যবহার মানে বিদেশী পণ্য ক্রয় হ্রাস করা।
তবে বাংলাদেশীদের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশীদের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা খুব কম। বাংলাদেশীরা দেশী পণ্য থেকে বিদেশী পণ্য ব্যবহার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ও গর্ববোধ করে। দোকানীকে গিয়ে বলে, আমাকে দেশী নয়, বিদেশী পণ্য দিন। বাংলাদেশীরা টাকা হলেই দেশ রেখে বিদেশে বেড়াতে যেতে যায়, বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়। এটা যে শুধু জনগণের মধ্যে সমস্যা তা নয়, সরকারও বিদেশ থেকে সেবা ও পণ্য আমদানি করতে বেশ আগ্রহী। দেশের অনেক কাজ দেশী কোম্পানি করতে পারলেও সরকার বিদেশী কোম্পানি দিয়ে তা করায়। দেশের থেকে বিদেশী লোক দিয়ে সেবা নিতে বেশি আগ্রহী হয়। দেশের মাটির নিচের সম্পদ রেখে বিদেশ থেকে আমদানিতে বেশি আগ্রহ দেখায়। বাংলাদেশে কোন দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়লে সাপ্লাই-ডিমান্ড চেইন ঠিক না করে আগে বিদেশ থেকে আমদানির ঘোষণা দেয়। অথচ দেখা যায়, বিদেশ থেকে পণ্য আসার আগেই পণ্যে দাম কমে যায়। বাংলাদেশে রিজার্ভ কমার যে খবর আমরা প্রতিনিয়ত পাই, সেটাই বলে দেয়, আমরা কতভাবে বিদেশী পণ্য ও সেবা নির্ভর হচ্ছি।
আবার আরেকটা বিষয় হলো, বাংলাদেশে এখন অনেক ইট-বালু-সিমেন্টের উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু এটাকে যথার্থ উন্নয়ন বলা যায় না। কারণ কোন পণ্য বা সেবার উন্নয়ন (development) তখনই ঘটেছে বলা যায়, যখন সেটি কমমূল্যে অধিক মানুষের ব্যবহার উপযোগ হয়। কিন্তু বর্তমান উন্নয়নে কোন কিছুর দাম কমেনি, বরং অর্থের বিনিময়ে সেবা বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে সহজ হবে। যেমন ধরুন- মোবাইল ফোন। আগে মোবাইল ফোনের অনেক দাম ছিলো। ধনী শ্রেণী সেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারতো, গরীবরা করতে পারতো না। কিন্তু মোবাইল ফোন প্রযুক্তিতে উন্নয়ন হলো। স্বল্প দামে গরীবরাও এখন মোবাইল কিনতে পারে। এটা হচ্ছে আসল উন্নয়ন (development)। কিন্তু আপনি একটা বড় সেতু, মেট্রোরেল বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বানলেন, সেটাতে দিয়ে বেশি খরচ করে কম সময়ে ও আরামে যেতে পারবেন, এটা কিন্তু আসলে উন্নয়ন না। বরং আর্থিক সামর্থবানদের জন্য টাকার বিনিময়ে সেবা বৃদ্ধি করা বলা যায়।
তবে আর্থিক সামর্থবানদের জন্য এসব স্থাপনা বানানো হলেও এর খরচ কিন্তু বহণ করতে হচ্ছে দেশের দরিদ্র-মধ্যবিত্তসহ সকল জনগণকে। মনে রাখবেন, যত উন্নয়নই হোক, সব খরচ কিন্তু আমাকে আপনাকেই বহন করতে হয়। হয় সেটা ট্যাক্স-ভ্যাট বাড়িয়ে, অথবা মূলস্ফীতি তৈরী করে, দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে। আবার দেখা যায়, দেশের বড় বড় প্রজেক্ট করা হচ্ছে বিদেশী কোম্পানিকে দিয়ে, তাদের কিস্তি শোধ করতে গেলেই রিজার্ভের উপর চাপ বাড়বে, ডলার খরচ হবে, আর তাকেই ডলারের মূল্যস্ফীতি সীমানা ক্রস করে দেশে ঢুকবে।
আসলে ধনীদের সেবা বৃদ্ধির আগের উন্নয়নটা করা দরকার ছিলো দেশীয় উৎপাদন খাতের। ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদেরকে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেয়া, প্রচুর কলকারখানা তৈরী করা হতো দেশের আসল উন্নয়ন। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের কিভাবে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়া যায়, সবার শুধু সেই চিন্তা। উদ্যোক্তারা নতুন কিছু করতে চাইলে নিয়ম-নীতি, অমুক ট্যাক্স, তমুক ট্যাক্স, পরিবেশবাদী সার্টিফিকেট, ফায়ার সার্টিফিকেট, ইটিপি, এই সেই বলে শুধু খরচ আর খরচ। ব্যবসা করতে এত ঝামেলা হওয়ায় মানুষ ব্যবসা না করে ব্যাংকে টাকা রেখে হারাম সুদ খেতে বেশি পছন্দ করে। এত উচ্চ হারে ট্যাক্স দেখে দেশের টাকা বিদেশে ট্র্যাক্স হেভেনে পাঠিয়ে দেয়।
এজন্য অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দিতে, সরকারকে দেশী উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীদের দেশের ভেতর উৎপাদন করতে সুযোগ করে দিতে হবে। ট্যাক্স হ্রাস করে দেশে বিনিয়োগ করতে দিতে হবে। কলকারখানা তৈরীতে নিয়ম-প্রথা সহজ করতে হবে। নিজ দেশের মাটির নিচের সম্পদ উত্তোলন করতে হবে। আমদানি হ্রাস করে শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আসতে হবে। দেশের কাজ দেশের জনগণ ও দেশী কোম্পানিকে দিয়ে করাতে হবে। ডলারের ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। আর সাধারণ জনগণের মধ্যে দেশের প্রতি ভালোবাসা তৈরী করতে হবে। দেশী পণ্য ও সেবা ব্যবহার করতে সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে, এবং বিদেশী পণ্য ও সেবা ব্যবহার করতে সবাইকে নিরুৎসাহিত করতে। সবাই যে ক্রয় করতে গিয়ে বলে- আমাকে বিদেশী নয়, দেশী পণ্য দিন। সবাই সচেতন হতে পারলে অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা অনেকটা সামাল দেয়া সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ।