বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে বাঁচতে ইসলামী দিবস পালনের গুরুত্ব

বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে বাঁচতে ইসলামী দিবস পালনের গুরুত্ব

 বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে বাঁচতে ইসলামী দিবস পালনের গুরুত্ব

 কিছুদিন আগে বাংলাদেশে নামধারী মুসলমানদের একটা অংশ খ্রিস্টানদের ক্রিসমাস পালন করলো। এরপর করলো খ্রিষ্টীয় নববর্ষ বা থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন। থার্টি ফার্স্টের দুই সপ্তাহ পর আবার শুরু হবে সাকরাইন। তার ৩ সপ্তাহ পর শুরু হবে ভ্যালেন্টাইন উইক। ৭ থেকে ১৪ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত চলবে বিভিন্ন উৎযাপন। রোজ ডে, প্রপোজ ডে, চকলেট ডে, টেডি ডে, প্রমিজ ডে, হাগ ডে, কিস ডে, ভ্যালেন্টাইন ডে আরো কত কি। সম্প্রতি বাংলাদেশের তরুণ সমাজের মধ্যে পশ্চিমা খ্রিস্টানদের অনুকরণে হ্যালোইন পালন ব্যাপকভাবে দেখা গিয়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরবে হ্যালোইন পালন বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে যেন আরো উৎসাহিত করে।

 বিষয়টিকে যদি শুধু বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন হিসেবে দেখা হয়, তবে আমার মনে হয় ভুল হবে। এটা অনেকটা নিজ সংস্কৃতির সংকটও বটে। কারণ একটা গ্লাস কখন খালি থাকে না। হয় পানি থাকবে, নয়ত বাতাস থাকবে।

মুসলিম তরুণরা বিজাতীয় সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে যাওয়ার জন্য শুধু অপরকে দায়ী করলে চলবে না,

বরং ইসলামী সংস্কৃতির সংকট এখানে অনেকাংশে দায়ী। আমরা শুধু বলে গেছি, ইসলামে সব আছে, ইসলামে সব আছে। ইসলাম ইজ দ্য কমপ্লিট কোড অব লাইফ। কিন্তু সেই ‘সব’টা কি তা দেখায় দিতে পারে নাই। এই ব্যর্থতাই আমাদের তরুণ সমাজ ঠেলে দিয়েছে বিজাতীয় সংস্কৃতির দিকে।

 ইতিহাস বলে, স্বর্ণযুগে মুসলমানদের সংস্কৃতির ভরপুর অবস্থা ছিলো। তখন মুসলমানদের সংস্কৃতিকে অন্য জাতির মধ্যে প্রবাহিত হতো। কিন্তু এখন মুসলিম সংস্কৃতি মুসলমাদের মাঝেই প্রবাহিত হয় না। মুসলমানের সন্তান জানে না, মুসলমানদের সংস্কৃতি কি? এর একটা বড় কারণ মুসলমান নিজেদের বিভিন্ন ঐতিহাসিক দিবস পালন করে না। কারণ সংস্কৃতি কালে কালে প্রবাহিত হয় একটা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে, ঐতিহাসিক দিবসসমূহ পালন হচ্ছে সেই উপলক্ষ। একটা উপলক্ষ তৈরী করে নিজেদের সংস্কৃতি প্রবাহের সেই সুযোগটা নিচ্ছে অন্য ধর্ম বা গোষ্ঠীগুলো। তাদের হাজার বছরের পুরাতন দিবসগুলোকে ফিরিয়ে এনে নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন করে উপস্থাপন করছে। ফলে সেই দিবসে ঝাপ দিচ্ছে নতুন প্রজন্ম। উদাহরণস্বরূপ খ্রিস্টানরা তাদের হাজার বছরের পুরাতন ভূত-প্রেত-পেত্নির কুসংস্কারাচ্ছন্ন হ্যালোইন সংস্কৃতি নতুন রূপে নিয়ে এসেছে, আর তা দেখে খ্রিস্টানরা তো বটেই নামধারী মুসলমানদের তরুণ সমাজও লাফ দিয়ে পড়েছে।

 মুসলমানদের মধ্যে উপলক্ষ তৈরীর বিষয়টি আটকে দিয়েছে এক শ্রেণীর নামধারী আলেম। তারা জ্ঞানের দৈন্যতার দরুণ ফতওয়া দিয়েছে দিবস পালন হারাম-বিদআত-শিরক। তাদের আজগুবি ফতওয়ার কারণে কোন উপলক্ষ তৈরী হয়নি, ফলে মুসলিম স্বর্ণযুগের মূল্যবান সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বর্তমানে তরুণ প্রজন্মে প্রবাহিত হতে পারে নাই। সৃষ্টি হয়েছে শূণ্যতা, আর সেখানেই দখল করে নিচ্ছে বিজাতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ।

 অথচ মহান আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে বলেছেন, “আর আমি মূসা (আলাইহিস সালাম) কে আমার আয়াতসমূহ দিয়ে পাঠিয়েছি যে, ‘আপনি আপনার কওমকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে বের করে আনুন এবং আল্লাহর দিবসসমূহ (ইসলামীক ঐতিহাসিক ঘটনার দিনসমূহ) তাদের স্মরণ করিয়ে দিন’। নিশ্চয় এতে প্রতিটি ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য রয়েছে অসংখ্য নিদর্শন।” ( পবিত্র সূরা ইব্রাহিম: ০৪)

 অর্থাৎ ঐতিহাসিক দিনসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়ার কথা পবিত্র কুরআন পাকেই আছে। কারণ প্রতিটা ঐতিহাসিক দিনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ শিক্ষা। যে দিনটা পালন করলে পূর্ববর্তীদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ নতুন প্রজন্মের মধ্যে প্রবাহিত হয়। মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরপুর হওয়ার জন্য এটা অনেক জরুরী ছিলো। কিন্তু সেটা হচ্ছে না।

 আসলে নামধারী আলেমদের চিন্তার গ্যাপটা আমি ধরিয়ে দিচ্ছি। তারা থার্টি ফার্স্ট, পহেলা বৈশাখ, ভ্যালেন্টাইন ডে’র কথা বলে- “এ সমস্ত দিবস পালন করা হারাম, তাহলে তাদের অনুসরণে সকল দিবস পালন করা হারাম। ” আসলে বিষয়টি এমন না। ইসলামে দিবস পালন করা যদি হারাম-বিদআত-শিরক হতো, তবে জুমুয়ার দিন, ঈদের দিন, আশুরার দিন, আরাফার দিন পালন করার বৈধতা থাকতো না। আসলে এখানে দিবস মূল না, মূল হচ্ছে দিবসটা কি উপলক্ষে পালন হচ্ছে সেটা। সেটা ঈমানী বিষয়ে নাকি কুফরী বিষয়ে? যদি ঈমানী বিষয়ে হয়, তবে সেটা হালাল। কিন্তু সেটা যদি কোন কুফরী বিষয়কে স্মরণ করে হয় তবে সেটা হারাম বা কুফরী।

 একইভাবে অনেকে বিভিন্ন দিবসে হারাম কাজ করে। এখানে দোষ কিন্তু দিবসে না, হারাম কাজ পালনে। হারাম কাজ বন্ধ করে দিলে হালাল দিবস অবশ্যই হালাল হবে। মূল কথা হলো- মাথা ব্যথার সমাধান মাথা কাটা না। কিন্তু আমাদের এক শ্রেনীর নামধারী আলেম সোজা সাপটা সকল দিবস পালন করা হারাম-বিদআত ফতওয়া দিয়ে মাথা ব্যথার চিকিৎসায় মাথা কেটে বিরাট ক্ষতি করে ফেলেছে, ‍মুসলমানদের করে ফেলেছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি শূণ্য।

 আমার মনে হয়, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ রক্ষার্থেই মুসলিম সমাজকে দিবস পালন বিরোধী ফতওয়া থেকে সরে আসতে হবে। মুসলমানদের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দিবস উৎযাপন শুরু করতে হবে। ঐ দিবসগুলোতে মুসলিমদের পূর্ববর্তী মনিষীদের জীবনী, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা হবে। মুসলিম সংস্কৃতি চর্চা হবে। নতুন প্রজন্ম সে উপলক্ষে বিষয়গুলো সম্পর্কে জানবে-চিনবে। তখনই মুসলমানরা অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আসবে, নিজ সংস্কৃতি ও মূলবোধ জেনে হীনমণ্যতা দূর করবে। সরে আসবে বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে।

Comments