কষ্টের দিন শেষ করে মুসলমানদের সফলতা আসবে যেভাবে
লেখক- এস হাবীব
বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা আজ নির্যাতিত। কাফির-মুশরিকরা নানান কায়দায় মুসলমানদের দমন-নিপীড়ন চালাচ্ছে। কাফির মুশরিকদের দেশে মুসলমানরা যেমন নির্যাতিত, তেমনি অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রেও মুসলমানরা নির্যাতিত। ইতিহাসের পাতায় আমরা পড়ি, একটা সময় সারা বিশ্বে মুসলমানরা নেতৃত্বে ছিলো, জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ সব সেক্টরে ছিলো একচেটিয়া আধিপত্য। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে মুসলমানরা সব হারিয়ে ফেলেছে।
মুসলমানরা কেন নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেললো, এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে, এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কারণ হচ্ছে, মুসলমানরা মুসলমান হিসেবে তার লক্ষ্য (Goal) হারিয়ে ফেলেছে। দিক হারিয়ে বিশাল সমুদ্রে জাহাজ যেমন ঘুরপাক খেয়ে নাজেহাল হয়, মুসলমানদের আজ তেমন অবস্থা।
চিন্তা করে দেখুন, আমরা আমাদের বাচ্চাদের ছোট থাকতেই লক্ষ্য ঠিক করে দেয়ার চেষ্টা করি। বলি ‘বড় হয়ে তোমাকে অমুক হতে হবে’। এগুলো কিন্তু ব্যক্তিগত লক্ষ্য। সে যেহেতু, একজন মুসলমান। তাই মুসলমান হিসেবে মুসলমান সমষ্টিগত লক্ষ্য থাকা উচিত। কিন্তু সেটাই তাকে দেয়া হয় না।
মূলতঃ লক্ষ্য (Goal) দুই ধরনের।
এক- ব্যক্তিগত (individual),
দুই- সমষ্টিগত (collective)
সন্তানকে শিক্ষা দিতে হলে তার ব্যক্তিগত লক্ষ্য যেমন ঠিক করে দিতে হবে। ঠিক তেমনি তার সমষ্টিগত লক্ষ্যও ঠিক করে দিতে হবে।
সমষ্টিগত লক্ষ্য (collective Goal) ঠিক করা কেন জরুরী?
কাফির মুশরিকরা মুসলমানদের উপর নির্যাতন করে, কারণ তারা চায়, সমাজে তাদের (সমষ্টিগত) আইন ও নিয়ম-নীতি প্রতিষ্ঠা হোক। কিন্তু মুসলমানরা সেখানে বাধার কারণ হতে পারে, এই আশঙ্কায় তারা মুসলমানদের উপর নিপীড়ন চালায়।
এক্ষেত্রে কাফির-মুশরিকদের কিন্তু সমষ্টিগত লক্ষ্য (collective Goal) ঠিক করা আছে। উদাহরণস্বরূপ- বর্তমানে যে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা নিয়ে ফেতনা, এত মুসলিম গণহত্যা, সেই ইসরাইল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য কিন্তু ইহুদীদের নতুন কিছু নয়, বরং হাজার বছরের পুরাতন লক্ষ্য। হাজার বছরের পুরাতন প্ল্যান অনুসারে কাজ করে তারা বর্তমান এই অবস্থায় এসেছে। আবার ভারতের দিকে যদি তাকান তবে একই জিনিস দেখবেন। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ রামায়নে বর্ণিত মহাভারত প্রতিষ্ঠার জন্য হিন্দুরা ভারত উপমহাদেশে আধিপত্য বিস্তারে চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেই প্রতিষ্ঠায় মুসলমানরা বাধা হতে পারে, এই আশঙ্কায় তারা মুসলমান নিপীড়ন করছে।
মূলতঃ মুসলমানদের পিছিয়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো, কাফিরদের সমষ্টিগত লক্ষ্য ঠিক করা থাকলেও মুসলমানদের কিন্তু সমষ্টিগত লক্ষ্য ঠিক করা নাই। কাফিররা তাদের লক্ষ্য অনুসারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু মুসলমানদের সমষ্টিগত লক্ষ্য-ই নাই, কাজ তো পরের বিষয়।
সমষ্টিগত লক্ষ্য (collective Goal) থাকলে সুবিধা কি, এটা বুঝতে একটা উদাহরণ দেই,
ধরুন কোন এলাকায় একজন ব্যবসায়ী আছে, যে কয়েক প্রজন্ম ধরে একই ব্যবসা করে। মানে সে ব্যবসা পেয়েছে তার বাবার থেকে। তার বাবা পেয়েছে তার বাবার থেকে। আবার তার বাবা পেয়েছে তার বাবার থেকে। এভাবে ৮-১০ প্রজন্ম একই ব্যবসা করতেছে। এখন নতুন কোন ব্যবসায়ী যদি ঐ ব্যবসায়ীর সাথে প্রতিযোগীতা করতে যায়, স্বাভাবিকভাবেই পেরে ওঠার কথা নয়। কারণ কয়েক প্রজন্ম ধরে তাদের মধ্যে যে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে, সেটা বুঝতেই নতুন ব্যবসায়ীর বহু সময় লেগে যাবে, তারপর সেটা আয়ত্ব করা এবং প্রতিযোগীতা করা তো অনেক পরের বিষয়।
কাফিররা মূলত এই কাজটি করে। লক্ষ্য উদ্দেশ্য ঠিক করে, তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই লক্ষ্য বরাবর এগিয়ে যায়। পিতা নিজে সেই কাজ করে এবং তার সন্তানকে তা হাতে কলমে শিক্ষা দেয়। অতঃপর মৃত্যুর আগে বলে যায়, “বাবা, আমাদের লক্ষ্য ঐ পর্যন্ত। আমি এতটুকু কাজ করলাম। আমার পর তুমি লক্ষ্যের দিকে কাজ এগিয়ে নিয়ো।” ঐ সন্তানও বাবার দেখানো লক্ষ্যে কাজ করে এবং একইসাথে নিজ সন্তানকেও হাতে কলমে শিক্ষা দেয়। অতঃপর মারা যাওয়ার পূর্বে সেও তার সন্তানকে একইভাবে অসিয়ত করে যায়, “বাবা, আমাদের লক্ষ্য কিন্তু ঐ পর্যন্ত। আমি এতটুকু কাজ করেছি, তুমি বাকিটা এগিয়ে নেবে।” এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের কাজ চলতে থাকে।
আবার লক্ষ্য ঠিক থাকায়, কাফিররা যে সেক্টরেই যাক, তারা প্রত্যেকে মূল লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থেই কাজ করে। ফলে তারা একটি সিন্ডিকেটের মত কাজ করে। ফলে মুসলমানরা ক্ষুদ্র পরিসরে প্রতিরোধ করতে গিয়ে তাদের সিন্ডিকেটের সাথে পেরে উঠে না। ঠিক যেভাবে, ব্যবসায় কোন সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর সাথে নতুন কোন প্রতিযোগী ব্যবসায়ী পেরে উঠে না। বরং ঐ সিন্ডিকেটের ধাক্কায় নতুন ব্যবসায়ী ছিটকে মূলধন হারিয়ে পথে বসে যায়।
অর্থাৎ কাফিরদের প্রজন্মের পর প্রজন্মে প্রবাহিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমানে মুসলমানরা হঠাৎ প্রতিরোধ গড়ে টিকতে পারে না। আবার তারাও থাকে বিরাট সিন্ডিকেট হয়ে, ফলে একক বা ক্ষুদ্র পরিসরে তাদের সাথে পেরে উঠা সম্ভবপর হয় না। আর এ সব সম্ভব হয় কাফিরদের সামষ্টিক লক্ষ্য ঠিক করে রাখার কারণে।
এজন্য মুসলমানদের উচিত তাদের কওম বা জাতি স্বার্থের জন্য একটি সামষ্টিক লক্ষ্য (collective Goal) ঠিক করা। এবং সেই লক্ষ্যে পৌছানোর প্ল্যান ঠিক করে সে অনুসারে কাজ শুরু করা এবং নিজ সন্তানকেও শিক্ষা দেয়া। এরপর সে যতটুকু পারলো করলো। সে মৃত্যুর পূর্বে তার সন্তানকে বলে যাবে, বাবা আমি এতটুকু করলাম বাকিটা তুমি পুরা করো। সেই সন্তান বাবার অনুসৃত পথে কাজ করবে এবং মৃত্যুর পূর্বে তার সন্তানকে ওসিয়ত করে যাবে, আমি এতটুকু করতে পারলাম, বাকিটা তুমি চালিয়ে নিয়ো। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লক্ষ্য অর্জনে কাজ হবে। আর সামষ্টিক লক্ষ্য (collective Goal) যখন জানা থাকবে, মুসলমানরা যে সেক্টর বা যে দেশেই যাক, তারা একটি দেহের মত কাজ করবে।
এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, সামষ্টিক লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করতে গেলে আপনার অর্জিত শিক্ষা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে প্রবাহিত করতে হবে। পরবর্তী প্রজন্ম আপনার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ও নিজের অর্জিত শিক্ষা দুটোকে এক করে তার পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে প্রবাহিত করবে। এভাবে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্ম ঐ নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে আরো বেশি অভিজ্ঞ বা জ্ঞান গর্ভ হয়ে উঠবে। এই যে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে শিক্ষা প্রবাহ এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রবাহের উপর সফলতা অনেকটা নির্ভর করে।
একটি উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। যেমন- মুহম্মদ বিন কাসিম রহমতুল্লাহি আলাইহির ভারত বিজয়ের ইতিহাস আমরা অনেকে শুনি। সেই সময় উনার বয়স ছিলো মাত্র ১৭ বছর। এই কথা শুনে আমরা অবাক হই। চিন্তা করি, এত কম বয়সে আমাদের বাচ্চাদের তো হাতে তুলে খাবার খাওয়ায় দিতে হয়, আর সেই সময় উনারা যুদ্ধের সেনাপতি হয় কিভাবে ?
আসলে এটাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত জ্ঞান-দক্ষতা তথা শিক্ষা । মুসলমানদের খিলাফত যুগে যুদ্ধের জ্ঞান ও দক্ষতা লাভ সহজলভ্য ছিলো। বাপ-দাদা থেকে প্রাপ্ত যুদ্ধ কৌশল-প্রশিক্ষণ সব পাওয়া। ফলে সেই যুগে ১৭ বছর বয়সে যুদ্ধের সেনাপতি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিলো না।
ঠিক যেমন আমাদের সময়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার। আমরা প্রথমে বাটন মোবাইল ব্যবহার করতাম। সেই মোবাইল ব্যবহার করতেই আমাদের অনেকের হিমশিম খেতে হতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এনড্রয়েড সেট এসেছে। এখন দুই-এক বছরের বাচ্চাও টাচ মোবাইল ব্যবহার করতে পারে। এই যে আমাদের সন্তান উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, এটা বাবা-মার থেকে প্রাপ্ত সহজলভ্য শিক্ষা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম প্রবাহিত শিক্ষা অনেক কিছুকে সহজ করে দেয়। ঠিক একইভাবে মুসলমান হিসেবে আপনি যখন মুসলমানদের সমষ্টিগত স্বার্থে কাজ করবেন, তখন এই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শিক্ষাটা প্রবাহিত হওয়াটা জরুরী। এতে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়ে যায়।
কিন্তু সমস্যা হলো, কাফিররা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শিক্ষা প্রবাহে বাধা দেয়, যেন মুসলমানরা বার বার বাধাগ্রস্ত হয়। এই বিষয়টাকে বলা হয় ‘জেনারেশন গ্যাপ’। কাফিররা মুসলমানদের মধ্যে ‘জেনারেশন গ্যাপ’ তৈরী করার জন্য বার বার চেষ্টা করে। যেমন- প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শিক্ষা প্রবাহের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বই। ইতিহাস ঘেটে দেখবেন, কাফিররা মুসলমানদের কোন এলাকা দখল করলে সেখানে বই ধ্বংস করতো। যেমন, হালাকু খানের বাগদাদ দখলের (সাল-১২৫৮) এর ইতিহাস আমরা সবাই জানি। সে সময় মুসলমানদের স্বর্ণযুগের জ্ঞান চর্চাসমূহ সংরক্ষিত ছিলো বায়তুল হিকমান লাইব্রেরীর বই সমূহে। হালাকু খান সেই বইগুলো ধ্বংস করে ফেলে। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের ভাষ্য অনুযায়ী দজলা নদীতে অসংখ্য বই ফেলে দেয়ার ফলে নদীর পানি বইয়ের কালির কারণে কালো হয়ে গিয়েছিল। ফলে মুসলমানদের অনেক জ্ঞান লুণ্ঠিত হয়, অনেক জ্ঞান নদীর পানিতে হারিয়ে যায়।
আবার প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জ্ঞান প্রবাহের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। ভাষা বদল করেও কাফিররা জেনারেশন গ্যাপ তৈরীর চেষ্টা করে। যেমন সুলতানি ও মোঘল ভারতীয় উপমহাদেশে আমাদের এ অঞ্চলের দাপ্তরিক ভাষা ছিলো ফারসী। ফারসী ভাষায় জ্ঞান চর্চায় তখন এ অঞ্চলের মুসলমানরা অভ্যস্ত ছিলো। মুসলমানরা সে সময় জ্ঞান চর্চায় অনেক উন্নত, যা ব্রিটিশদের কাছে ছিলো স্বপ্নের মত। ব্রিটিশরা মুসলমানদের সেই জ্ঞান আটকানো জন্য ফারসী ভাষা পরিবর্তন করে ইংরেজী চালু করে দেয়। ফলে ফারসী ভাষায় যে সমস্ত জ্ঞান চর্চা ছিলো, তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ঠিক মত প্রবাহিত হতে পারে নাই। মুসলমানরা এ অঞ্চলে ইংরেজী ভাষা অধ্যয়ন শুরু করলো এবং সব কিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হলো।
এজন্য বর্তমান নির্যাতিত ও নিপীড়িত অবস্থা থেকে উত্তরণ করে স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনার জন্য মুসলমানদের একটি সামষ্টিক লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। সেই সামষ্টিক লক্ষ্যে নিজে যেমন কাজ করতে হবে ঠিক তেমনি মৃত্যুর পূর্বে অসিয়ত করতে হবে সে ও তার পরবর্তী প্রজন্ম যেন সামষ্টিক লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যায়। পাশাপাশি এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, কাফিররা যেন জেনারেশন গ্যাপ তৈরী করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় বাধা না দিতে পারে। মুসলমানরা যখন সচেতন হবে, কাফিররা তখন আর কোন ক্ষতি করতে পারবে না ইনশাল্লাহ।