শিক্ষা ব্যবস্থা কেন ধ্বংস করা হয়?
-শেখ মুহম্মদ রাফসানযানি
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। কোন জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা মানে তার মেরুদণ্ড ধ্বংস করা। কোন ব্যক্তির মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হলে যেমন সে আর সোজা হয়ে দাড়াতে পারে না, তেমনি কোন জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হলে সে জাতি আর মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারে না। নুয়ে থাকে।
ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে আসার আগে এ অঞ্চলে মুসলমান প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত উচু দরের ছিলো। সেই সময় মুসলমান প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো আরবী ও ফারসী ভাষার উপর নির্ভর। মুসলমানরা তো অবশ্যই হিন্দুরাও সেই ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতো। কিন্তু উঁচু দরের শিক্ষা ব্যবস্থা থাকলে তো মানুষ উচু থাকবে, তাকে তো আর নিচু করা যাবে না, শাসন করা যাবে না। তাই এ অঞ্চলে এসে ব্রিটিশরা প্রথমে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করেছিলো। প্রবর্তন করেছিলো তাদের বানানো নিচু দরের শিক্ষা ব্যবস্থা।
কিন্তু ব্রিটিশরা যখন মুসলমান প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আসে, তখন শিক্ষিত মুসলমানরা সেই নিচু দরের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বর্জন করে। ইতিহাসে এ বিষয়টি ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা হয়। বলা হয়, “মুসলমানরা নাকি ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ না করে পিছিয়ে পড়েছে। হিন্দুরা গ্রহণ করে এগিয়ে গিয়েছে। ” আসলে বিষয়টি এমন না। মুসলমানরা তখন উচ্চ শিক্ষিত এবং তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক উচু দরের। কিন্তু ব্রিটিশরা যখন সেই শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আসে , তখন মুসলমানরা সেটা বর্জন করে। কারণ উচু ছেড়ে কেউ নিচু জিনিস নিতে চায় না।
ইতিহাসের পাতায় ব্রিটিশরা কিন্তু এ কথা স্বীকার করে গেছে। যেমন-
১. এ এম ই সি বেইলি বলে- “তাদের কাছে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল, যেটা আমরা ধ্বংস করেছি যা দ্বারা অত্যন্ত উচ্চমানের বুদ্ধিগত প্রশিক্ষন ও বিকাশ ঘটানো সম্ভব। এই শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তির মাঝে কোনরুপ ত্রুটি নেই, যদিও এটির উপস্থাপন পদ্ধতিটি অত্যন্ত পুরনো, তারপরও এটি তৎকালীন ভারতের যেকোন শিক্ষাব্যবস্থা থেকে অসীম মাত্রায় শ্রেষ্ঠ। এই শিক্ষাব্যবস্থাই তাদেরকে বুদ্ধিগত ও উপাদানগত শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিয়েছে।” (তথ্যসূত্র: Hunter, W. W. Indian Mussalmans, p. 133)
২. ইংরেজ পণ্ডিত জেনারেল স্লিম্যান মন্তব্য করে, “ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার যে রকম অগ্রগতি হয়েছে, পৃথিবীর খুব কম সম্প্রদায়ের মধ্যেই সে রকম প্রসার হয়েছে। যে ব্যক্তি মাসে ২০ টাকা বেতনের চাকুরী করেন, তিনিও তার সন্তানকে প্রধানমন্ত্রীর সন্তানের সমতূল্য শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। তারা আরবী ও ফারসী ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করেন, যা আমাদের কলেজ যুবকেরা গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার মাধ্যমে ব্যকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, তর্কোশাস্ত্র, শিক্ষা পেয়ে থাকে। মাত্র সাত বছরকাল অধ্যয়নের পর একজন মুসলমান যুবক মাথায় পাগড়ী পরিধান করে এবং অক্সফোর্ড থেকে পাশ করা নব্য যুবকের মতই- জ্ঞানের সেই সকল সংশ্লিষ্ট শাখায় পূর্ণতা লাভ করে থাকে। সে সক্রেটিস, এ্যারিস্টটল, প্লেটো, হিপোক্রেটিস, গ্যালন ও ইবনে সিনা সম্বন্ধে অনর্গল আলোচনা করতে পারে।” (তথ্যসূত্র: Sleeman, W. H. Rambles and Recollections of an Indian Official, Vol-II, London, 1893, pp. 523-524)
৩. উইলিয়াম অ্যাডম তার রিপোর্টে (১৮৩৫-১৮৩৮) বাংলায় এক লক্ষ প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলো বলে উল্লেখ করেন। (তথ্যসূত্র: Long, J., Adam's Reports. pp. 18-19)
উপরের ৩টি রেফারেন্স দ্বারা প্রমাণ হয়, ব্রিটিশরা আসার আগেই এ অঞ্চলের মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষায় অসম্ভবরকম উন্নত ছিলো, শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক বিস্তৃত ছিলো, যা দর্শণে খোদ ব্রিটিশ দস্যুরাও অবাক হয়ে যায়। ব্রিটিশরাই বলছে তারা এ অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। কারণ তারা জানত মুসলমানরা যদি ঐ শিক্ষা ব্যবস্থা ধারণ করে তবে তাদের কখন শাসন করা যাবে না। কারণ মাথা নিচু লোককে শাসন করা যায়, উচু লোককে করা যায় না। আর সেই উচ্চ মাথা নিচু করতেই উচ্চমানের ঐ শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে ব্রিটিশরা নিম্নমানের গোলামি শিক্ষা ব্যবস্থা এ অঞ্চলে চাপিয়ে দেয়, আর তার দরুণ এ অঞ্চলে ২০০ বছর শাসন করে ব্রিটিশরা। শুধু তাই না, ব্রিটিশ প্রবর্তিত গোলামির শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে এ অঞ্চলের মানুষ এখনও চিন্তাধারায় ব্রিটিশ গোলামির পিঞ্জর থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।
বর্তমানেও বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। নতুন পাঠ্যপুস্তকে দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়-
১. পাঠ্যপুস্তকে নীতি নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
২. পাঠ্যপুস্তকে বিজ্ঞান পাঠকে আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস করা হয়েছে।
একটি জাতিকে নীতি-নৈতিকতাহীন করে দিলে, ঐ জাতি অপকর্মে জড়িয়ে যাবে। আর নীতি-নৈতিকতাহীন জাতি কখনো মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারবে না। আবার একটি জাতিকে বিজ্ঞান পাঠ থেকে দূরে ঢেলে দিলে সেই জাতি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে, অর্থনীতিতে মাথা তুলে দাড়াতে পারবে না। যেমন- বর্তমানে বিশ্বে যে সকল দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী হিসেবে গণ্য করা হয়, সেই সমস্ত প্রতিটি দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অন্য দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগামী থাকার কারণে তারা অর্থনীতিতেও এগিয়ে যায় এবং অন্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এখন বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রগুলো যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ধিরে ধিরে আগাতে থাকে, তবে এক সময় বাংলাদেশও অর্থনীতিতেও এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের উপর সম্রাজ্যবাদীদের ক্ষমতা বা প্রভাব খাটানো সহজ হবে না। এজন্য বাংলাদেশের নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পাঠকে উদ্দেশ্যমূলক হ্রাস করা হয়েছে, যেন বাংলাদেশীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানে দুর্বল হয়ে যায়। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিও শক্তিশালী হবে না এবং বাংলাদেশকে শাসন করাও সহজ হবে। বাংলাদেশীরা নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারবে না, বরং মানুষকে স্বল্পমূল্যে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহৃত করা যাবে।
আজ থেকে কয়েকশ’ বছর আগে যেমন ব্রিটিশরা যেমন এদেশে মুসলমান প্রবর্তিত উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছিলো, ঠিক তেমনি বর্তমানেও সম্রাজ্যবাদীদের প্রেসক্রিপশনে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের কার্যক্রম চলছে। এর বিরুদ্ধে প্রত্যেকের সচেতন হওয়া এবং প্রতিবাদ করা অত্যন্ত জরুরী।