দুনিয়াবী জ্ঞান নেয়া এবং দ্বীনি জ্ঞান নেয়ার পদ্ধতি একই

দুনিয়াবী জ্ঞান নেয়া এবং দ্বীনি জ্ঞান নেয়ার পদ্ধতি একই

দুনিয়াবী জ্ঞান নেয়া এবং দ্বীনি জ্ঞান নেয়ার পদ্ধতি একই

 -মুহম্মদ গোলাম সামদানী

 আমি যদি বলি, প্রকৃত দ্বীনি জ্ঞান নেয়ার জন্য আমি একজন শায়েখ বা মুর্শিদ বা পীর সাহেবের কাছে মুরিদ (ছাত্র) হয়েছি, আমি সেই পীর সাহেবের দরবার শরীফে যাই, উনার সোহবত (সাহচার্য) ইখতিয়ার করি, আদেশ নির্দেশ অনুসারে চলার চেষ্টা করি, উনার খিদমত করার কোশেষ করি, মহান আল্লাহ পাক উনার এবং আখেরী নবী হাবীবুল্লাহু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মারিফত, মুহব্বত অর্জনের কোশেষ করি। তাহলে এ কথা শুনে হয়ত কেউ কেউ বলতে পারেন, পীর সাহেবের কাছে বাইয়াত হওয়ার কি দরকার? উনার দরবার শরীফে যাওয়ার কি দরকার? পবিত্র কুরআন হাদীসেই তো সব জ্ঞান আছে। আর মাদ্রাসায় পড়লেই তো হয়, বাড়তি পড়ার দরকার কি? আর তাছাড়া উনার খিদমত, উনার আদেশ নির্দেশ অনুসারে চলার বিষয়টা বাড়াবাড়ি। আল্লাহ পাক ছাড়া কারো অনুগত হওয়া আমার পছন্দ না।

 যারা এ ধরনের কথা বলেন, আমার ধারণা তারা দ্বীন সম্পর্কে যেমন জানে না, তেমনি দুনিয়া সম্পর্কেও তারা বেখবর। একজন হক্কানী পীর সাহেবের দরবার শরীফ থেকে জ্ঞান নেয়ার যে পদ্ধতি, দুনিয়াবী ক্ষেত্রেও কেউ কোন বিষয়ে সঠিক ও বাস্তবমুখী জ্ঞান আহরন করতে গেলেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।

 যেমন, কেউ যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে গবেষণামূলক পড়ালেখা করতে চান। অথবা কেউ যদি পেশাগত জীবনে বাস্তবমুখী জ্ঞান লাভ করতে চান, তবে অবশ্যই তাকে একজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক বা অভিজ্ঞ ব্যক্তির স্মরণাপন্ন হতে হয়। সেই অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাথে থেকে শিখতে হয়। তার সাথে আলাদা সময় দিয়ে, উঠা-বসা করে সেই জ্ঞান অর্জন করতে হয়। সাথে থেকে সোহবত ইখতিয়ার করে যে জ্ঞান পাওয়া যায়, তা অন্য কোনভাবে পাওয়া যায় না।

 বিষয়টি উদাহরণ বললে বুঝতে সহজ হবে। যেমন ধরুন, প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষ করে কেউ বাস্তবজীবনে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবি কিংবা সাংবাদিক হতে চান। এক্ষেত্রে প্রথমে ঐ ব্যক্তিকে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার, বিশেষজ্ঞ আইনবিদ, বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকের সরণাপন্ন হতে হবে। অতঃপর সেই বিশেষজ্ঞের যদি কোন চেম্বার থাকে সেই চেম্বারের সদস্য হতে হবে। অতঃপর সেই চেম্বারের সদস্য হয়ে ঐ বিশেষজ্ঞের কাছে হাতে কলমে বিষয়টি শিখতে হবে।

 এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, জুনিয়র ব্যক্তি প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষ করে এসেছেন, তারপরও সিনিয়র বিশেষজ্ঞের সাথে থেকে এমন কিছু জ্ঞান ও দক্ষতা পায়, যা সে এত বছর বই পাঠ করে পায়নি। দেখা যায় সিনিয়রের থেকে প্রাপ্ত সামান্য জ্ঞান জুনিয়রকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যায়। সিনিয়রের দেয়া একটা ছোট বুদ্ধি জুনিয়রের পেশাগত জীবন পাল্টে দেয়, কিন্তু সেই বুদ্ধিটা কিন্তু কোন বইপত্রে লেখা থাকে না। সিনিয়রের ভেতর থাকা সেই গোপন জ্ঞান ও দক্ষতা পাওয়ার জন্য জুনিয়ররা ঝাপিয়ে পড়ে। সিনিয়রের খাওয়া এগিয়ে দেয়া, থালা প্লেট মাজা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা করা, বাসার বাজার করে দেয়া, বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নানান গিফট দেয়া থেকে শুরু নানান সেবার মাধ্যমে সিনিয়রের দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করে। উদ্দেশ্য একটাই সিনিয়রের কাছে এমন কিছু জ্ঞান আছে, সেই জ্ঞানের সামান্য যদি জুনিয়রকে দেয়, তবে পেশাগত জীবনে জুনিয়রের ব্যাপক উন্নতি ঘটবে। এতে বড় ডাক্তারের সাথে থেকে জুনিয়রও বড় ডাক্তার হয়ে যায়। বড় উকিলের সাথে থেকে জুনিয়রও বড় উকিল হয়ে যায়, বড় ইঞ্জিনিয়ারের সাথে জুনিয়রও বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যায়, বড় সাংবাদিকের সাথে থেকে জুনিয়রও বড় সাংবাদিক হয়ে যায়। এটা সিনিয়র থেকে পাওয়া জুনিয়রের জ্ঞান। এই জ্ঞান বইপত্রে পাওয়া যায় না, এই জ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিলি হয় না। এই জ্ঞান সিনিয়রের সাথে থেকে, তার মন যুগিয়ে, তাকে খুশি করে পেতে হয়। অনেক সময় সিনিয়র খুশি হয়ে গেলে, তার পুরো জ্ঞান, দক্ষতা পুরোটাই জুনিয়রকে দিয়ে যায়। আর তাতেই ভাগ্য খুলে যায় জুনিয়রের।

 এজন্য পেশাগত জীবনে অভিজ্ঞ সিনিয়রকে সর্বদা খুশি করতে চায় জুনিয়র। তার সেবা পরিচর্যা করে মন জুগিয়ে থাকতে চায়। তবে সিনিয়র থেকে সেই মহামূল্যবান জ্ঞান নেয়া এত সহজ হয় না। দেখা যায় সিনিয়রের অধিনে অনেক জুনিয়র আসে, সবাই চেষ্টা করে, কিন্তু অধিকাংশ সফল হয় না। অনেকে বেশি কষ্ট করতে চায় না, কম কষ্ট করে সাফল্য পেতে চায়। এরা বেশি দূর আগাতে পারে না। আবার অনেকে পরিশ্রমী হয়, দৃঢ়চিত্ত হয়ে লেগে থাকে, সিনিয়রের বিশ্বস্ত থাকে, সকল কথা শুনে, আদব ঠিক রাখে, বেয়াদবি করে না। সিনিয়র সেই জুনিয়রকেই পছন্দ করে, তাকে আস্তে আস্তে সেই তার অর্জিত গোপন জ্ঞান শেখাতে থাকে এবং অবসর বা মৃত্যুর সময় তার বাকি কাজের দায়িত্ব দিয়ে যায়।

 এতক্ষণ আমি যে কথাগুলো বললাম, যারা বাস্তবমুখী শিক্ষা অর্জন করতে চান, পেশাগত জীবনে সফল হতে চান, তারা প্রত্যেকেই জানেন সেই জ্ঞান কিভাবে লাভ করতে হয়েছে তাকে। একজন বিশেষজ্ঞের অধীনে থেকে শিক্ষা নেয়া ছাড়া আরেকজন বিশেষজ্ঞ কখনই হওয়া যায় না। শুধু বই পড়ে অথবা গণশিক্ষা বা সবার সাথে একসাথে পড়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান পাওয়া কঠিন। কোন একজন বিশেষজ্ঞর অধীনে থেকে তার কাছাকাছি গিয়ে শিখতে পারলে খুব দ্রুত শিক্ষা পাওয়া সম্ভব।

 আমি অবাক হই এটা ভেবে, শিক্ষিত সমাজ টাকা কামাই করার জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তবমুখী জ্ঞান বা বিশেষজ্ঞ হওয়ার পদ্ধতিটি সহজে বুঝতে পারে, কিন্তু দ্বীন ইসলামের জন্য সঠিক জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতিটি বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না, দ্বীন ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা মানে মহান আল্লাহ পাক এবং উনার প্রিয়তম হাবীব হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মারেফত মুহব্বতের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ বা পীর সাহেব বা শায়েখের স্মরনাপন্ন হতে হয়, উনার সোহবত ইখতিয়ার করতে হয়, উনার নির্দেশিত মত-পথে চলতে হয়। তখন তিনি সেই গোপন জ্ঞান বা তত্ত্ব দান করেন, যা অন্যভাবে পাওয়া কখনই সম্ভব না।

 এজন্য কথায় বলে, যে দুনিয়া ভালো বুঝে, সে দ্বীনও ভালো বুঝতে পারবে। দুনিয়াবী ক্ষেত্রে বাস্তবমুখী জ্ঞান পদ্ধতি যে বুঝতে পারবে, সেও প্রকৃত দ্বীনি জ্ঞান নেয়ার জন্য পীর সাহেবের কাছে বায়াত হওয়ার বিষয়গুলোও ভালো করে বুঝতে পারবে।

Comments