বেতন বৃদ্ধি না জীবনযাত্রা ব্যয় হ্রাস, কোনটা বেশি দরকার?

বেতন বৃদ্ধি না জীবনযাত্রা ব্যয় হ্রাস, কোনটা বেশি দরকার?

 বেতন বৃদ্ধি না জীবনযাত্রা ব্যয় হ্রাস, কোনটা বেশি দরকার?

-শেখ মুহম্মদ রাফসানযানি

 সম্প্রতি বেতন বৃদ্ধির জন্য গার্মেন্টস শ্রমিকরা আন্দোলন করার পর সরকার ঘোষণা দিয়েছে, গার্মেন্টস মালিকদের শ্রমিকদের বেতন নূন্যতম ৮ হাজার টাকা থেকে উন্নতি করে ১২ হাজার ৫শ’ টাকা করতে হবে। এছাড়া বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধি হবে ৫%। সরকারের এ ঘোষণার পর অনেক শ্রমিক সংগঠন অবশ্য এ বেতন বৃদ্ধিকে সামান্য বলে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা আরো বেতন বৃদ্ধির দাবী জানায়। তাদের এ দাবী অবশ্যই যুক্তিসংগত। কারণ বর্তমান দ্রব্যমূল্যর উর্ধ্বগতির বাজারে এই সামান্য বেতন দিয়ে জীবন নির্বাহ করা শুধু কঠিন নয়, বরং অসম্ভব।

 তবে এই সমস্যা শুধু গার্মেন্টস শ্রমিকদেরই নয়, বরং প্রতিটি সেক্টরে। প্রাপ্য বেতন দিয়ে সংসার চালানো এখন খুব কঠিন। তবে আমার মনে হয়, শুধু বেতন বৃদ্ধি করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। বরং দৃষ্টি দিতে হবে জীবনযাত্রার ব্যয় (living cost) বৃদ্ধিতে লাগাম টেনে। কারণ বাসা ভাড়া, দ্রব্যমূল্য, গাড়ি ভাড়া সবকিছুইতেই উর্ধ্বগতি। বেতন যতই বৃদ্ধি করেন, সব কিছুর দামও তো বাড়ছে। তাহলে বেশি বেতনে কি লাভ হবে? উদাহরণস্বরূপ, আপনি আগে ৫০০ টাকা দিয়ে যে বাজার করতেন, এখন সেই বাজার করতে ১ হাজার টাকা লাগে। এখন আপনার বেতন যদি ডবল করা হয়, তবে লাভ কি? এর থেকে বরং জীবনযাত্রা ব্যয় হ্রাস করলে আপনার ৫০০ টাকার মধ্যে যদি ২০০ টাকা বেঁচে যায়, তাহলে বরং লাভ। লক্ষ্য করেন দেখুন, গার্মেন্টস শ্রমিকদের বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধি ৫%। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, বর্তমান খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১২% এর বেশি। তাহলে ৫% শতাংশ বেতন বৃদ্ধি করে ১২% খাবারের দাম বাড়লে কি আসলেই ফায়দা হবে?

একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে সহজ হবে, আফ্রিকান রাষ্ট্র সোমালিল্যান্ড বা জিম্বাবুয়ের সব কিছু দাম বৃদ্ধি ও মুদ্রার অবমূল্যায়নের কথা অনেক শুনবেন। সেখানে বস্তা ভরে টাকা দিয়ে এক টুকরা রুটি কিনতে হতো। রাস্তায় টাকার বস্তা ফেলে রাখলেও চোর তা চুরি করতো না। অর্থাৎ জীবনযাত্রা ব্যয় বৃদ্ধির লাগাম যদি না টানতে পারেন, তবে হাজার বেতন বাড়িয়েও লাভ হবে না। বস্তা ভরে টাকা পাবেন, কিন্তু টাকার দাম থাকবে না।

 আবার শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কিন্তু আছে। শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। উৎপাদন খরচ ঠিক রাখার জন্য মালিকপক্ষ তখন অটোমেশনের দিকে ঝুঁকে। এতে শ্রমিকের বদলে মেশিন দিয়ে উৎপাদন করা হবে, তখন খরচ কমবে এবং উৎপাদনও দ্রুত হবে। গার্মেন্টস সেক্টরে অটোমেশনের ফলে শ্রমিক ছাঁটাই অবধারিত। এজন্য অনেক সময় শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি আন্দোলনের পেছনে শ্রমিকদের স্বার্থ না যতটুকু থাকে, তার থেকে বেশি থাকে মেশিনারিজ কোম্পানিগুলোর স্বার্থ। কারণ শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি হলে শ্রমিকদের স্থান দখল করবে মেশিন, আর তাতে মেশিন বিক্রি করে মেশিনারিজ কোম্পানিগুলো প্রচুর লাভ করবে। এজন্য অনেকের ধারণা, শ্রমিকদের আন্দোলনের পেছনে ইন্ধন থাকে বড় বড় মেশিনারিজ কোম্পানিগুলোর। স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিকরা হয়ত বুঝতেই পারে না, তাদেরকে পেছন থেকে ইন্ধনদাতারা তাদেরকে বেকার করে মেশিন বিক্রির ধান্ধায় নেমেছে।

 আবার বেতন বাড়ালে আপনি কয়টি সেক্টরে বেতন বাড়াবেন? জীবযাত্রার ব্যয় (living cost) বৃদ্ধি তো সব সেক্টরেই, ফলে সব সেক্টরেই বেতন বৃদ্ধি দরকার। কিন্তু ব্যয় হ্রাস করলে সব সেক্টরের মানুষ উপকৃত হবে।

 আসলে মানুষের ব্যয়ের অনেক খাত আছে, তবে জনসাধারণের প্রধান তিনটি-

১) বাসা ভাড়া

২) দ্রব্যমূল্য

৩) গাড়িভাড়া

 বাংলাদেশে এই ৩টি হ্রাস করা সম্ভব একটি কাজ করলে, সেটা হলো রাজধানীকে বিকেন্দ্রীকরণ। রাজধানী ঢাকাকে যদি বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়, কর্মস্থল যদি সারা দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেয়া যায়, তবে রাজধানীর জনসংখ্যা কমে আসবে, আর রাজধানীর জনসংখ্যা কমে গেলে বাসার চাহিদা কমে যাবে, আর বাসার চাহিদা কমলে বাসায় টু-লেট ঝুলবে মাসের পর মাস। তখন ভাড়াটিয়া পেতে বাসা ভাড়া কমাতে বাধ্য হবে বাড়িওয়ালা। আবার যে ঢাকার বাইরে গেলো, তারও বাড়িভাড়া কমবে।

 রাজধানীর জনসংখ্যা হ্রাস করা গেলে যানজটও হ্রাস পাবে, তখন এত এত মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে বানানোর প্রয়োজন পড়বে না। মূলতঃ যানজট হ্রাসের নামে এসব অতিরিক্ত মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ের যে খরচ হচ্ছে, যা জনগণের খরচ বাড়িয়ে মানে চাল-ডাল-তেল নূনের দাম বাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে। এসব মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে বানানোর প্রয়োজন না হলে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ানোরও প্রয়োজন হবে না।

 আবার রাজধানীতে জনসংখ্যা হ্রাস পেলে যানজট হ্রাস পাবে, আর যানজট হ্রাস পেলে গাড়ির জ্বালানি খরচ কমবে, আর গাড়ির জ্বালানি খরচ কম হলে গাড়ি ভাড়াও কমবে।

 এজন্য বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনের থেকে বেশি দরকার জীবনযাত্রা ব্যয় হ্রাসের জন্য আন্দোলন করা। তবে শুধু আন্দোলন করলেই হবে না, বরং সমাধান কিভাবে তার সুনির্দ্দিষ্ট রূপরেখা তৈরী করে সরকারের কাছে দাবী তুলতে হবে।

সরকারকে বলতে হবে, শুধু রাজধানী কেন্দ্রীক ইট-বালি সিমেস্টের কাঠামো নির্মাণে বিপুল ইনভেস্ট না করে, রাজধানীর বাইরে সারা দেশে উৎপাদনশীল খাতে ইনভেস্ট করুন, যেন সারা দেশজুড়ে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং মানুষ রাজধানী ছেড়ে বিভিন্ন জেলায় কর্মের জন্য চলে যায়। এতে খরচ অনেক কমিয়ে ফেলা সম্ভব।

মনে রাখবেন, জনগণ সঠিক দাবী না করতে পারলে, সঠিক সমাধান কখনই হবে না। বরং সমাধানের নামে নিত্য-নতুন প্রজেক্ট করে জনগণের খরচ আরো বাড়িয়ে তোলা হবে। এতে জনদুর্ভোগ হ্রাস নয়, বরং প্রতিনিয়ত বাড়তেই থাকবে।

Comments