আসছে ভোট নির্বাচন, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একজন খাঁটি মুসলমান বা আলেমের ভূমিকা যেমন হওয়া উচিত
-মুহম্মদ মহিউদ্দিন রাহাত
আর কিছুদিন পর বাংলাদেশে ভোট-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোটের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার আগামী ৫ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। বাস্তবে নতুন সরকার গঠনে জনগণের ভোটের প্রভাব কতটুকু, সেটা তর্কের বিষয়। তারপরও ভোট দিয়ে যদি জনগণ কোন সরকার গঠন করতেও পারতো, তবে দেশের মুসলমান বা ইসলামের খুব একটা বেশি ফায়দা হতো না। কারণ ফায়দাটা মুসলমানরা কিভাবে তুলবে, সেটাই মুসলমানরাই জানে না।
আসলে আমরা এখন যে ভোট, গণতন্ত্র, নির্বাচন দেখছি, এগুলো হচ্ছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার (state mechanism) একটি অংশ। উপনিবেশীয় ব্যবস্থার (colonialism) পতনের পর পৃথিবী জুড়ে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমদানি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অল্প করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুরোদস্তুর রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছড়িয়ে দেয়া হয় বিশ্বজুড়ে। উপনিবেশগুলো ভেঙ্গে পৃথিবী জুড়ে শত শত রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এবং সেই রাষ্ট্রগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরী হয় জাতিসংঘকে। মূলতঃ এর মাধ্যমে কাফিরদের উপনিবেশবাদের (colonialism) এর নতুন ধারা নব্য উপনিবেশবাদ (neo- colonialism) প্রতিষ্ঠা হয়, যেখানে উপনিবেশ কাফির শক্তিগুলো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য (ভেটো পাওয়ার) হয়ে পৃথিবীর সকল দেশের উপর কর্তৃত্ব খাটায়।
মূলতঃ রাষ্ট্র ব্যবস্থাটা ইহুদী-নাসারাদের বানানো মেকানিজম। এর ভেতরের কল-কবজা, চলন-বলন পদ্ধতি সব তাদের নখদর্পে। আমরা মুসলমানরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা (state mechanism) সম্পর্কে কতটুকু বা জানি? না জেনে শুধু লাফ দিলে এর থেকে আমরা খুব বেশি লাভবান হতে পারবো বলে মনে হয় না, বরং যারা এটি বানিয়েছে, তারা আমাদের থেকে বেশি ফায়দা তুলে নিতে পারবে।
আমাদের দেশে কিছু ইসলামপন্থীদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, তারা প্রায় বলে, “আগে ভোট দিয়ে ক্ষমতার চেয়ারে বসাও, তারপর পুরো দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবো। ” তারা ভাবে, চেয়ার মানেই বোধ হয় সবকিছু। তারা ভাবে, চেয়ারে বসলেই বোধহয় রাষ্ট্র সিস্টেম ঘুরিয়ে ইসলামী করে ফেলা সম্ভব। এটা আসলে ভুল চিন্তা। তাদের এ ধরনের উদ্ভট চিন্তা প্রমাণ করে, তারা আসলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানে না। আর যারা রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে ভালো বুঝে না, তারা ক্ষমতায় গেলেও ইসলাম ও মুসলমানদের খুব একটা লাভ হবে, এমনটা মনে হয় না।
মূলত রাষ্ট্র ব্যবস্থাটা ইহুদী-নাসারারা এমনভাবে তৈরী করেছে যে, চেয়ারে আপনি যত উপরে উঠতে থাকবেন, আপনাকে তত বেশি ইসলামী মূল্যবোধ ত্যাগ করে কাফিরদের পলিসি মানতে হবে। উপরে উঠতে উঠতে আপনি হয়ত সর্বোচ্চ চেয়ারেও বসতে পারেন। কিন্তু ততক্ষণে দেখবেন, ইসলামের কথা দিয়ে শুরু করলেও শেষে এসে আপনার মধ্যে ইসলামের নাম গন্ধও নেই। অর্থাৎ যে কাফিরদের পলিসি সর্বোচ্চ মানতে পারবে, সেই চেয়ারে সর্বোচ্চ সিটে উঠতে পারবে। মানে চেয়ার থাকবে, কিন্তু চেয়ারে যে বসবে তার ক্ষমতা থাকবে না, ক্ষমতা থাকবে আড়ালে কাফিরদের হাতে। চেয়ারে বসে যদি কেউ তাদের দেয়া পলিসির বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম করে, তবে তাকে সাথে সাথে চেয়ার থেকে নামিয়ে দেয়া হবে। সম্প্রতিক সময়ে মিশরের মুরসি বা পাকিস্তানের ইমরান খান এর বড় উদাহরণ। এটাই আসলে নব্য উপনিবেশবাদ (neo- colonialism), যেখানে ছোট ছোট রাষ্ট্র বানিয়ে তার চেয়ারে হয়ত ঐ দেশেরই কাউকে বসানো হচ্ছে, কিন্তু তাকে বিভিন্ন নিয়ম-কানুনে আটকে কাফিরদের পলিসি অনুসারেই দেশ চালাতে বাধ্য করা হচ্ছে।
এজন্য যে চেয়ারে আসল ক্ষমতাই থাকে না, সে চেয়ারের পেছনে দৌঁড়ানো খাঁটি মুসলমান বা আলেমদের জন্য ভুল। বরং চেয়ারে উঠতে গেলে তাকে ইসলাম-ই ত্যাগ করতে হবে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের এক বয়ঃবৃদ্ধ আইনজীবি (যে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য) একবার নিজ দল সম্পর্কে আমাকে বলেছিলো, “জামায়াতে ইসলাম গণতন্ত্র করতে করতে এখন ‘ইসলাম’টা বাদ দিয়ে শুধু জামায়াতটা রাখছে।”
আসলে চেয়ার দখল করলেই যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যেতো, তবে ২০০১-০৬ সালে জোট সরকারে তো তথাকথিত ইসলামী দলগুলো ক্ষমতা পেয়েছিলো, কেউ কেউ মন্ত্রী-এমপিও হয়েছিলো, তারা নিজ মন্ত্রণলয় বা আসনে কতটুকু ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলো? পারে তো নাই, উপরন্তু শিল্প মন্ত্রণলয়ের দায়িত্ব পেয়ে এক তথাকথিত ইসলামের দলের শীর্ষ নেতা মদের দাম হ্রাস করে মদকে সহজলভ্য করে দিয়েছিলো। নাউযুবিল্লাহ।
তাছাড়া ইহুদী-নাসারাদের বানানো রাষ্ট্র পদ্ধতিটা নোংরা জিনিস। যারা এর ক্ষমতায় আসার জন্য রাজনীতি করে তারাও জানে তারা নোংরা কাজ করছে। মারামারি, কাটাকাটি, ঘুষ দেয়া, ভোট চুরি, মিথ্যা বলা মিথ্যা প্রচার এগুলো রাষ্ট্র পদ্ধতির অনুসঙ্গ। সুতরাং কেউ যদি সেই রাষ্ট্র পদ্ধতিতে ঢুকতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই মারামারি, চুরি, ঘুষ, মিথ্যায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এবং সেগুলো করেই তাকে এই নোংরা সিস্টেমে টিকে থাকতে হবে।
এজন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, একজন খাঁটি মুসলমান বা আলেমের অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটা নির্ভর করবে, ঐ মুসলমান বা আলেম আসলে কি চান, তার উপর।
যদি ঐ তথাকথিত মুসলমান বা আলেমের ইচ্ছা হয়, চেয়ার দখল করা, তবে সে নির্বাচন করুক।
আর যদি উনার উদ্দেশ্য হয়, দ্বীন ইসলাম বা মুসলমানের জন্য কিছু করা, তবে আমার মনে হয় তাকে ভোট-গণতন্ত্র, নির্বাচন দলাদলির মধ্যে না ঢোকাই উত্তম।
হয়ত বলতে পারেন, চেয়ারে না বসেও কি রাষ্ট্রের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব?
উত্তর হচ্ছে, সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব।
বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় চেয়ারে না বসেও প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব। অনেক বেসরকারি সংস্থা বা মানুষ চেয়ারে না থেকেও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো মিডিয়া, এনজিও ও সুশীল সমাজ। কিন্তু তারপরও এদের পলিসিতে ঠিকই রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন-কানুন পরিবর্তন হয়, জনগণের মাঝে নিত্য, নতুন সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ জনগণের উপর এমপি-মন্ত্রীর প্রভাব যতটুকু, তার থেকে মিডিয়া, এনজিও ও সুশীল সমাজের প্রভাব অনেক বেশি। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, অনেক সময় তাদের পলিসি অনুসারে এমপি-মন্ত্রীরাও আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়। এজন্য একজন খাঁটি মুসলমান বা আলেমের মূল উদ্দেশ্য যদি থাকে, মানুষের চিন্তা চেতনায় প্রভাব বিস্তার করা, সমাজে দ্বীন ইসলাম জারি করা, তবে সে ভোট-গণতন্ত্র-নির্বাচন পদ্ধতিতে না গিয়ে ভিন্ন পদ্ধতিতেও তা করতে পারে।
আবার বলা হয়, রাষ্ট্রের মালিক হচ্ছে জনগণ। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেই জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচিত হয়। অর্থাৎ জনগণ ৫ বছরের জন্য কিছু লোককে কর্মচারি হিসেবে নিয়োগ দেয়, উদ্দেশ্য- রাষ্ট্র পরিচালনা করা।
অপরদিকে একজন আলেম হচ্ছেন জনগণের অভিভাবক। অভিভাবক হচ্ছে তিনি, যার দিক নির্দেশনায় সাধারণ মানুষ চলে। কথা হচ্ছে, কর্মচারি আর অভিভাবক কি এক সমান হতে পারেন কখন?
কখনই না। বাংলাদেশের অনেক তথাকথিত আলেম এই ভুলটা করছে। তারা অভিভাবকের স্থান ছেড়ে কর্মচারির স্থান নিতে চাইছে, চেয়ারে বসতে চেয়েছে। আর এর মাধ্যমে তারা ইসলাম ও মুসলমানদের হেয় করছে। তাদের ভুল হয়েছে, এই নোংরা সিম্টেমের ভেতর ঢুকে নিজেদের নিচু কাতারে নিয়ে যাওয়া।
ইতিহাস বলে ব্রিটিশরা ক্ষমতায় এসে আলেমের মর্যাদা ভূলণ্ঠিত করেছিলো। ব্রিটিশদের প্রভাবে একজন খাঁটি মুসলমান বা আলেমের অবস্থান কোথায় হবে, সেটা তারা নিজেরাই ভুলে গিয়েছে। কিন্তু যেসব দেশ উপনিবেশ শাসিত ছিলো না, সেখানে কিছুটাও হলেই আলেমের মর্যাদা টিকে আছে। যেমন, ইরান। ইরান শিয়া রাষ্ট্র। শিয়ারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকিদা অনুসারে বাতিল। কিন্তু ইরান ইউরোপীয় উপনিবেশের অংশ ছিলো না। ফলে ইরানে কিছুটা হলেও তাদের আলেমদের মর্যাদা টিকে আছে। যেমন- ইরানে ‘আয়াতুল্লাহ’ নামক পদ আছে, যাকে তারা সর্বোচ্চ নেতা বা শীর্ষ আলেম বলে। আয়াতুল্লাহ যে পলিসি দেয়, রাজনৈতিক দলগুলো সেই পলিসিকে বাস্তবায়নের জন্য রাজনীতি করে। অর্থাৎ কোন রাজনৈতিক দল কত বেশি আয়াতুল্লাহ’র কথা মানবে, তার উপর নির্ভর করবে তার জনপ্রিয়তা। আর যার যত বেশি জনপ্রিয়তা, তার ক্ষমতা তত বেশি। তাই রাজনীতিবিদরা বেশি জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য বেশি করে আয়াতুল্লাহ’র কথা মানে। এভাবে ইরানে শিয়া আলেমের অবস্থান রাজনীতির উপরে থাকে, তারা চেয়ারে বসে না, কিন্তু তাদের কথা অনুসারেই কাজ হয়।
আবার ধরুন, তুরস্কের কথা। একটা সময় কামাল পাশা সেক্যুলারিজম দিয়ে দেশটার ইসলামী চেতনা ধ্বংস করে গেছে। তুরস্কে কিন্তু নকশবন্দিয়া তরিকার অনেক সুফী-পীর সাহেব ছিলেন ও আছেন। উনারা কিন্তু সরাসরি রাজনীতিতে নামেনি। ভোট-গণতন্ত্র নির্বাচন করেননি। তবে হ্যা, ঐ সমস্ত পীর সাহেব সূফিদের থেকে চিন্তাধারা নিয়ে রাজনীতিবিদরা দেশ ও জাতির জন্য অনেক কাজ করেছেন। বর্তমানে এরদোয়ানসহ তুরস্কের অনেক রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবিরা নকশবন্দিয়া-সুফী পীর সাহেবদের খানকা শরীফে যাতায়াত করতেন। সূফী পীর সাহেবদের থেকে তালিম নিয়ে সেই রাজনীতিবিদরা আজকে কামাল পাশার রেখে যাওয়া সেক্যুলারিজম নিঃশেষ করার জন্য কাজ করছে। কিন্তু পীর সাহেবগণ কিন্তু তাদের তালিম-তালক্বিন, ইলমে তাসাউফ চর্চার মধ্যেই থেকেছেন, এর বাইরে যাননি। অর্থাৎ উনারা অভিভাবক হিসেবে উপরে ছিলেন। উনাদের কথায় সবাই চলতো। উনারা রাজনীতির ময়দানে নেমে আলেমের মর্যাদা পথে প্রান্তরে নামিয়ে দেননি।
এজন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় খাঁটি মুসলমান বা আলেমগণকে জনগণের অভিভাবকের স্থানে থাকতে হবে, ক্ষমতার চেয়ারের লোভে নিচে নেমে গেলে চলবে না। তখন হয়ত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মুসলমান বা দ্বীন ইসলামের জন্য কিছু পাওয়া সম্ভব, এর আগে না।
Mohammad Nasir Uddin Ummiyyi 1 y
অনেক মূলবান পোস্ট শুকরিয়া বেশুমার