ফিলিস্তিনের মুক্তিকামীরা কেন সফল হয়, অন্যরা কেন সফল হয় না?
-ইঞ্জিনিয়ার মুহম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান
বর্তমানে গাজায় ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী ও ইসরাইলের মধ্যে সংঘাত চলমান। ইসরাইল বিশ্বের শক্তিশালী প্রযুক্তি, যুদ্ধাস্ত্রের দাবীদার। সেই শক্তি নিয়ে তারা ঝাপিয়ে পড়েছে হামাসসহ ফিলিস্তিনের মুক্তিকামীদলগুলোর উপর। খুজছে তাদের তন্নতন্ন করে। কিন্তু এত শক্তিধর হওয়ার পরও তারা তুলনামূলক স্বল্পপযুক্তির ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের কাছে প্রতিনিয়ত নাস্তানাবুদ হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, হামাস ও অন্যান্য মুক্তিকামীদের কাছে কি এমন শক্তি আছে, যার কারণ তারা এত শক্তিশালী দলকে নাকানি চুবানি খাওয়াচ্ছে? পৃথিবীর অনেক এলাকাতেই তো কাফির মুশরিকরা মুসলমানদের যুলুম নিপীড়ন করছে। সে সব এলাকার মুসলমানরা তো সফলতা পাচ্ছে না। কিন্তু তারা কেন সফল হচ্ছে? কারণ কি? আজ আমাদের আলোচনা সে বিষয় নিয়ে।
প্রথমেই আপনাদের একটি হাদীস শরীফ বলবো। হাদীস শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছেন, আখেরী নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “শীঘ্রই এমন একসময় আসবে, যখন এই পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিরা (কাফিররা) একে অপরকে মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য পরস্পরকে আহবান করবে, যেমনটি খাওয়ার দস্তরখানের দিকে লোকদের ডাকা হয়ে থাকে!” কেউ একজন জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূল্লাহ ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! সেই সময় কি আমরা সংখ্যায় কম থাকবো?” উত্তরে আখেরী নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করলেন, “না, সে সময় সংখ্যায় তোমরা হবে অগণিত। কিন্তু তোমরা হবে বানের পানিতে ভেসে আসা খড়কুটোর মতো [অর্থাৎ, শক্তিহীন]। শত্রুদের অন্তরে তোমাদের সম্পর্কে যে ভয় আছে মহান আল্লাহ পাক তা উঠিয়ে নেবেন এবং তোমাদের অন্তরে তিনি ওহান নিক্ষেপ করবেন।” একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! ওহান কি?” উত্তরে তিনি বললেন, “দুনিয়ার প্রতি মুহব্বত আর মৃত্যুর প্রতি অনিহা বা ভয়।” [আবু দাউদ এবং আহমদ]
এ হাদীস শরীফ পাঠ করে আমরা বুঝতে পারি, মুসলমানরা যখন পরকালের কথা ভুলে দুনিয়াতে মশগুল হবে তখনই কাফিররা মুসলমানদের উপর প্রাধান্য পাবে। বর্তমানে তাই হচ্ছে। মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভুলে, মুসলমানরা দুনিয়ার মুহব্বতে গরক হয়ে গেছে। দুনিয়ার ক্যারিয়ার, টাকা পয়সা তাদের কাছে বড়। কাফির-ফাসেকরা কি বললো, কি মনে করলো, সেটা তাদের কাছে অনেক বড়। এজন্য তারা কাফিরদের বিরুদ্ধে কিছু করতে বা বলতে ভয় পায়। আবার তারা কাফিরদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়লে যদি কাফিররা তাদের মেরে ফেলে, এই মৃত্যু ভয়ও পায় তারা। অর্থাৎ বর্তমান মুসলমানদের দুনিয়ার প্রতি মুহব্বত তৈরী হয়েছে এবং মৃত্যুর প্রতি ভয় বা অনিহা তৈরী হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায়, মুসলমানদের অন্তরে ওহান প্রবেশ করেছে এবং কাফিরদের অন্তর থেকে মুসলমানদের প্রতি ভয়কে তুলে নেয়া হয়েছে। আর তাতেই সারা বিশ্বে মুসলমানদের সংখ্যা প্রচুর হওয়া সত্ত্বেও তারা পেরে উঠছে না, বরং কাফিররা একত্র হয়ে তাদের উপর জুলুম নির্যাতন করছে।
এ পরিস্থিতিতে ব্যতিক্রম দেখিয়েছে ফিলিস্তিনের হামাসসহ বিভিন্ন মুক্তিকামী দলগুলো। তারা উল্টো কাফিরদের নিস্তানাবুদ করেছে। এর কারণ-
প্রথমত, তারা দুনিয়াকে পাত্তা দেয় নাই। মানুষ কি মনে করলো, কাফিররা কি বললো, কাফিরদের কত ক্ষমতা আছে, এগুলো তারা বিন্দুমাত্র হিসেব করে নাই। তাদের কাছে দুনিয়াবী ধন সম্পদের থেকে বেশি মূল্যবান বায়তুল মুকাদ্দাস শরীফ। সেই বায়তুল মুকাদ্দাস শরীফের খিদমতে তারা নিজেদের উজার করেছেন।
দ্বিতীয়ত, হামাসসহ বিভিন্ন মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিরা মৃত্যু ভয়কে ভুলে গেছে। তারা মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার জন্য প্রস্তুত। কাফিররা শহীদ করলে করুক, দখলদার ইসরাইলীদের ধ্বংস করতে হবে, এটাই তাদের ব্রত।
অর্থাৎ মুক্তিকামীরা দুনিয়ার মুহব্বতকে ছেড়ে দিয়েছে আর মৃত্যুকে বরণ করতে শিখেছে। এই দুই কারণে তাদের অন্তরের ওহান উঠে গেছে আর তাতেই দখলদার ইসরাইলের উপর প্রাধান্য লাভ করেছে।
আবার মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ মুবারক করেন, নিশ্চয়ই যারা ঈমানের উপর ইস্তেকামাত থাকেন মহান আল্লাহ পাক তাদের প্রতি ফিরিশতা নাজিল (গায়েবি মদদ) করেন। (সূরা: হামীম সিজদাহ-৩০)
গাজার শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার মুখে একটাই কথা– “হাসবুনাল্লহ্ ওয়া নি’মাল ওয়াকিল”- তারা মহান আল্লাহ পাক ছাড়া কারো উপর নির্ভর করে না, তাই তাদের জন্য আল্লাহ পাক তিনি যথেষ্ট। তারা ইসরাইলের দখলদায়িত্ব মেনে নেয়নি, ইস্তেকামাত থেকে যুদ্ধ করেছে। ফলে তাদের জন্য এসেছে মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে এসেছে সাহায্য ও গায়েবী মদদ। দেখা গেছে, ইসরাইলের সর্ব আধুনিক সার্ভিলেন্স (নজরদারি) প্রযুক্তি ঠিক মত কাজ করছে না, অত্যাধুনিক মারকাভা ট্যাংক, যার মূল্য ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, তা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মাত্র ৩০০ ডলারের রকেট দিয়ে। মুক্তিকামী সেনারা দৃশ্য-অদৃশ্য হয়ে দখলদার ইসরাইলীদের বোকা বানাচ্ছে, তাদেরকে হত্যা করছে, ফলে হামাসকে ‘ভূত’ বলে উল্লেখ করেছে ইসরাইলী দখলদাররা। ইসরাইলীরা যুদ্ধ বিমান থেকে অনেক বোমা ফেলছে, কিন্তু সবগুলো ফুটছে না। ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে ইসরাইলের সহস্রাধিক ট্যাংক, সাজোয়া ও যুদ্ধ যান। ইসরাইলের সেনাবাহিনী নিজেরাই নিজেদের গুলি করে মারছে, ওদের আয়রন ডোম ওদের উপর ফুটছে। অনেক দখলদার ইসরাইলী সেনা পাগল হচ্ছে, মানসিক বিকৃতি হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ভয়ঙ্কর সুপারবাগ এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স রোগের আক্রমণ। অনেক হামাস যোদ্ধা বর্ণনা করেছেন, অদৃশ্য থেকে আগত যোদ্ধাদেরকে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে পর্যন্ত তারা দেখছেন। এগুলো মহান আল্লাহ পাক উনার গায়েবী মদদ ছাড়া কি হতে পারে?
এজন্য বর্তমান ফিলিস্তিন ও দখলদার ইসরাইলের মধ্যে সংঘাত সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা। এ থেকে মুসলমানদের জন্য শিক্ষা হচ্ছে, যদি মুসলমানরা যদি দুনিয়ার মুহব্বত বাদ দিতে পারে, ভুলে যেতে পারে মৃত্যুভয়, তবে পৃথিবীর কোন কাফির, সে যত বড় শক্তিশালী হোক, মুসলমানদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। পাশাপাশি একজন মুসলমান যখন ঈমান আনবে এবং ইস্তেকামাত থাকবে, তখন তার জন্য মহান আল্লাহ পাক গায়েবী মদদ করবেন এবং কুদরতি সাহায্য করবেন। ফলে মুসলমানরা সফল হবে। অপরদিকে মুসলমানরা যদি দুনিয়ার মুহব্বত ছাড়তে না পারে, মৃত্যুর ভয় করে সাহস করে এগিয়ে না যায়, তবে কাফিরদের সাথে পেরে উঠবে না। আবার ঈমান আনার পর যদি ইস্তাকামাত না থাকে তবেও আল্লাহ পাক উনার থেকে সাহায্য বা গায়েবী মদদ পাবে না। ফলে সে সফলও হতে পারবে না। মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে এ বিষয়গুলো অনুধাবন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।