বাল্যবিয়ে ও সামাজিক নিরাপত্তা

বাল্যবিয়ে ও সামাজিক নিরাপত্তা

বাল্যবিয়ে ও সামাজিক নিরাপত্তা

লেখা: মুহম্মদ শফিউর রহমান

 বর্তমানে বাল্যবিয়ে নিয়ে বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য শোনা যায়। বিদেশী অর্থায়নে এনজিওগুলো বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে মাঠ পর্যায়ে বেশ সক্রিয়। মিডিয়াতেও বাল্যবিয়ে বিরোধী বিজ্ঞাপন চলে। রাষ্ট্র সে অনুসারে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন পাশ করে বাল্যবিয়ে হ্রাসের চেষ্টা করছে।

 আসলে ‘বিয়ে’ সমাজ ও পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ, তাই এর সাথে সামাজিক বন্ধন ও নিরাপত্তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আইন করে কিংবা চাপ প্রয়োগ করে এর গুরুত্ব কম বেশি করা যায় না। বরং সামাজিক চাহিদা বা গুরুত্ব থেকেই এর প্রয়োজনীয়তা তৈরী হয়।

 প্রসঙ্গ হচ্ছে বাল্যবিয়ে। মূলতঃ আমরা যে সামাজিক সিস্টেমে বসবাস করি, তাতে অনেক ধরনের মানুষ বসবাস করে। একেক জনের সামাজিক অবস্থান, চাহিদা, লক্ষ্য একেক রকম। সবাইকে এক দাড়িপাল্লায় পরিমাপ করা বোকামি। প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান ও চাহিদা অনুসারে তার বয়স ভেদে বিয়ের প্রয়োজনীতা তৈরী হয়। কিন্তু সবাইকে এক কাতারে ফেলে প্রত্যেকের জন্য এক আইন, এক নিয়ম করলে সবাই সেটা সামাল নাও দিতে পারে। এতে কারো কারো সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।

 যেমন,

 ১. কোন সন্তান অল্প বয়সে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে বা জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এতে সন্তানের ভবিষ্যত তো অবশ্যই, পিতা-মাতার সামাজিক মান-সম্মান ক্ষুন্ন হওয়ার সমূহ সম্ভবনা আছে। এক্ষেত্রে ‍পিতা-মাতা চান সন্তানকে ১৮ বছরের আগেই বিয়ে দিতে। কিন্তু আইনের মারপ্যাচ থাকায় পিতা-মাতা সন্তানকে ১৮ বছরের নিচে বিয়ে দিতে পারছেন না।

 ২. কোন সন্তানের বয়স ১৮ বছরের কম, কিন্তু পিতা-মাতার বয়স বেশি, অথবা পিতা-মাতা অসুস্থ। পিতা-মাতা চিন্তা করছেন, তাদের মৃত্যু বা বড় অসুস্থতা ঘটে গেলে সন্তানের ভবিষ্যত কি হবে ? এক্ষেত্রে সন্তানকে বিয়ে দিয়ে অনেক চাপ নিরসন করতে চান তারা। কিন্তু আইন থাকায়, প্রয়োজন সত্ত্বেও তারা সন্তানকে বিয়ে দিতে পারছেন না।

 ৩. বাল্যবিয়ের সাথে সন্তান বৃদ্ধির একটি সম্পর্ক বিদ্যমান। কোন পরিবারে যদি বাল্যবিয়ে হয়, তবে সেই পরিবারে অধিক সন্তান জন্মগ্রহণ করার সম্ভবনা থাকে। কিন্তু যত বেশি বয়সে বিয়ে হবে, সন্তানের সংখ্যা তত কম হতে পারে। দেখা যায়, একজন পিতা-মাতা যখন বৃদ্ধ হয়ে যায়, অসুস্থ হয়ে যায়, তখন যদি তার সন্তান কম থাকে, তবে অনেক ক্ষেত্রে তার দেখাশোনায় সমস্যা হয়।  বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ভরণ-পোষণ, চিকিৎসা খরচ এক বা দুই জন সন্তান বহন করতে পারে না, পিতা-মাতার সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। কিন্তু সন্তানের সংখ্যা যদি বেশি হয়, তবে বৃদ্ধ বয়সে একজন সন্তান না দেখলে আরেকজন দেখা শোনা করে। অথবা সবাই মিলে মিশে খরচ বহন করে, দেখা শোনা করে। অর্থাৎ বাল্যবিয়ের সাথে বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতার সামাজিক নিরাপত্তারও একটা যোগসাজস আছে।

 ৪. বিয়ের বয়স যত বেশি হয়, সন্তানের থেকে সাহায্যপ্রাপ্তির আশা তত কম হয়। সব মানুষ তো অতিরিক্ত সম্পত্তি গড়তে পারে না, প্রতিনিয়ত আয় করেই সংসার চালাতে হয়। খরচ বেড়ে যাওয়া, সংসার বড় হওয়াতে এক সময় পিতা সব খরচ বহন করতে পারে না। তার সাহায্যকারী হাত প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে তার সন্তান হতে পারে বাবার সাহায্যকারী। কিন্তু বেশি বয়সে বিয়ে করার কারণে দেখা যায় বাবার বয়স হয়ে গেছে ৬০, সন্তান এখনও নাবালেগ, লেখাপড়াই শেষ হয় নাই। আবার অনেক ক্ষেত্রে পিতার বয়স বাড়তে স্ট্রোক, প্যারালাইসিসসহ নানান দুর্ঘটনা ঘটতে পারে অথবা মারাও যেতে পারে। কিন্তু দেখা যায়, সন্তান তখনও ছোট, সংসারের হাল ধরার মত তার অবস্থা এখনও হয় নাই। কিন্তু পিতা-মাতা কম বয়সে বিয়ে করলে, ভবিষ্যতে এ ধরনের সমস্যা আর হয় না।

 ৫. একটা সময় ছিলো, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কম হলেও আমরা ৫ প্রজন্মকে এক সাথে দেখতে পেতাম। আমি অনেক পরিবারে কন্যা সন্তান, তার মা, তার মা বা নানী, নানীর মা, নানীর নানীকে এক সাথে দেখেছি। কিন্তু বর্তমানে ৫ম বা ৪র্থ প্রজন্ম এক সাথে হওয়া কমে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে তিন প্রজন্মকে এক সাথে জীবিত পাওয়া যায় না। এই যে প্রজন্ম হ্রাস পাচ্ছে, এর মূল কারণ হলো বাল্যবিয়ে হ্রাস।  প্রজন্ম বড় হওয়া, একদিকে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য যেমন জরুরী, ঠিক তেমনি সামাজিক নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের জন্য তেমনি জরুরী। বর্তমানে আমরা নতুন প্রজন্মকে নিয়ে চিন্তিত, তাদের মধ্যে মূল্যবোধ ও আদর্শ সংকট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সব শিক্ষা তো আর স্কুল কলেজ বা বই-পুস্তকে পাওয়া যায় না। শিক্ষার একটা বড় অংশ আসে পরিবার থেকে। যেহেতু প্রজন্ম সংকুচিত হচ্ছে, সেহেতু আমাদের নতুন প্রজন্ম সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শ সংকটে পড়ছে।

 ৬. বর্তমানে টিভি, সিনেমা, নাটকে যেসব অভিনেত্রী অভিনয় করে তাদের মধ্যে বিয়ে করার প্রবণতা কম। তারা বলে, ‘বিয়ে করলে ক্যারিয়ার নষ্ট হয়’। দেখা যায়, এসব অভিনেত্রী বৃদ্ধ বয়সে, আর্থিক ও সামাজিক সংকটে পরে। মানুষের কাছে হাত পাতে, অনেককে ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেখা যায়। আসলে যারা টিভি-সিনেমা-নাটকে অভিনয় করে তারা হলো এন্টারটেইনার। মানুষকে এন্টারটেইনমেন্ট বা বিনোদন দেয়া তাদের উদ্দেশ্যে। মানুষকে বিনোদন দেয়ার জন্য তারা সময়মত বিয়ে করে না, এতে একটা সময় গিয়ে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।

ঠিক একইভাবে আইন করে যখন মেয়েদের বিয়ের বয়স প্রলম্বিত করা হয়, তখন অনেক মেয়ে বিনোদনের খোরাকে পরিণত হয়, ভোগাবাদী দুনিয়ায় অনেকের ভোগ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে, কিন্তু দিনশেষে তার ভবিষ্যত সামাজিক নিরাপত্তা সংকটে পরে, যা এক চরম সত্য।

 আসলে বাল্যবিয়ে সবাইকে করতেই হবে বিষয়টি এমন নয়। কারো যদি প্রয়োজন থাকে, তবে তাকে অবশ্যই বাল্যবিয়ে করতে দেয়া উচিত। বিয়ের বয়সে কোন বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত না। কারণ সমাজে অনেকের বাল্যবিয়ের প্রয়োজন লাগতে পারে। আবার অনেকের নাও লাগতে পারে। কার লাগবে আর কার লাগবে না, এটা সমাজ ও পরিবারই নির্ধারণ করবে। বর্তমানে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭–এর ১৯ ধারা নামক একটি বিশেষ ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে- ‘বাবা-মা সর্বোত্তম স্বার্থে আইনী প্রক্রিয়ায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানকে বিয়ে দিতে পারবেন।’ কিন্তু এই বিশেষ ধারা সংযুক্ত হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ বা আইনী বাস্তবায়ন কিভাবে হবে তার সুনির্দ্দিষ্ট রূপরেখা নেই। যে কারণে এই বিশেষ ধারার সুযোগ-সুবিধা মানুষ পাচ্ছে না।

 মূলতঃ বিয়ে হচ্ছে একটি সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় বিষয়। এর সাথে সামাজিক নিরাপত্তা ও মূল্যবোধ জড়িত। রাষ্ট্র বা বহিঃরাষ্ট্র কখনই এর উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না। রাষ্ট্র বা বহিঃরাষ্ট্র যখনই এ বিষয়ে হস্তপেক্ষ করবে, তখন সামাজিক নিরাপত্তা ও মূল্যবোধে ভাঙ্গন ঘটবে, যা আমাদের ও আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কখনই সুখকর হবে না। তাই ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ নামক কোন আইন-ই থাকা উচিত না। বিয়ের বয়সের বিষয়টিকে সম্পূর্ণরূপে সমাজ, পরিবার ও ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। তারাই প্রয়োজন ও ‍সুবিধমত সময়ে বিয়ের ব্যবস্থা করবে, রাষ্ট্রের সেখানে কোন হস্তক্ষেপ থাকবে না।

 

Comments