কথিত ৪র্থ শিল্প বিপ্লব এবং নতুন শিক্ষা কারিকুলামে বাচ্চাদের হাতে ডিভাইস তুলে দেয়া

কথিত ৪র্থ শিল্প বিপ্লব এবং নতুন শিক্ষা কারিকুলামে বাচ্চাদের হাতে ডিভাইস তুলে দেয়া

 কথিত ৪র্থ শিল্প বিপ্লব এবং নতুন শিক্ষা কারিকুলামে বাচ্চাদের হাতে ডিভাইস তুলে দেয়া

-শেখ মুহম্মদ রাফসানযানি

 কয়েক বছর আগে ‘করোনা ভাইরাস’ কে কেন্দ্র করে জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়, সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউন। লক্ষণীয় ছিলো, ভাইরাসের ভয় দেখিয়ে সব কিছু অনলাইনে করানো। ক্লাস-পরীক্ষা, অফিস-আদালত, বাজার-সদাই, ব্যাংকিং লেনদেন, ডাক্তার দেখানো, গল্প-গুজব, মিটিংসহ সব কিছু বাস্তব দুনিয়া ছেড়ে অনলাইনে বা ভার্চুয়াল জগতে করতে বলা হয়। কেউ না করলে তাকে করা হয় হেনস্থা। এজন্য করোনা যখন প্রথম আসে, তখন কেউ কেউ বলেছিলো, করোনা এসেছে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবকে জাগ্রত করতে।

 ৪র্থ শিল্প বিল্পব কি?

৪র্থ শিল্প বিল্পব বলতে মূলত বোঝায় মানুষ বাস্তব দুনিয়া ছেড়ে সবকিছু ভার্চুয়াল দুনিয়ায় করবে। কম্পিউটার, মোবাইল, ট্যাবলেড, ইন্টারনেট-ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়া, এআই ইত্যাদিতে পুরোপুরি অভ্যস্ত হবে।

যেহেতু মানুষ বাস্তব দুনিয়া ছেড়ে সহজে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আসতে চাইছিলো না, তাই একটি ভাইরাসকে পূজি করে ভীতি ছড়ানোর মাধ্যমে মানুষকে বাস্তব দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় অভ্যস্ত করাই ছিলো করোনা ভীতির মূল কারিশমা।

 সম্প্রতি শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার পর একটি কথা ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে, সেটা হলো- এবারের কারিকুলামের কারণে বাচ্চারা ডিভাইস মানে মোবাইল, ট্যাব ইত্যাদির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আপনার কাছে হয়ত মনে হচ্ছে, ডিভাইসের দিকে বাচ্চাদের ঝুকিয়ে দেয়া বোধহয় এমনি এমনি হচ্ছে। আসলে বিষয়টি এমন নয়। করোনার সময় ঠিক যে কারণে বাচ্চাদের ভাইরাসের ভয় দেখিয়ে অনলাইন ক্লাস করানোর নামে বাচ্চাদের ডিভাইসে অভ্যস্ত করার একটি প্রয়াস ছিলো, এখনও ঠিক তাই। অর্থাৎ তাদের কথিত ৪র্থ শিল্প বিপ্লব সফল করতেই বাচ্চাদের ডিভাইসমুখী করা।

৪র্থ শিল্প বিপ্লব হলে কে লাভবান হবে?

 হাট বা আড়ৎ সম্পর্কে কোন ধারণা আছে আপনাদের? বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা হাট বা আড়াতে তাদের মালামাল উঠায়। ক্রেতারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের জন্য সেই হাট বা আড়তে জমায়েত হয়। অতঃপর কেনাকাটা শেষ হলে হাট বা আড়তের একটি বাড়তি খরচ বা হাসিল পরিশোধ করে। হাট বা আড়তের স্থানের মালিক কোন ক্রয়-বিক্রয়ে জড়িত না হয়েও শুধু স্থান দেয়ার কারণে একটা অর্থ পায়।

 ঠিক একইভাবে ৪র্থ শিল্প বিপ্লব হচ্ছে, এতদিন মানুষ বাস্তব দুনিয়ার আড়ৎ বা হাটে সবকিছু করতো। ফলে সেখানে কোন না কোন উপায়ে খরচ দিতো। কিন্তু এখন সব কিছু ভার্চুয়াল হাট বা আড়তে নিয়ে যাবে। ফলে ভার্চুয়াল দুনিয়ার যে সব হাট বা আড়ত মালিক আছে, তারা তত বেশি অর্থের মালিক হবে। গুগল, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, অ্যামাজনের মত বড় বড় ভার্চুয়াল হাট মালিকরা চায় তাদের হাটে মানুষ বেশি আসুক। কেনাবেচা বেশি হোক। তাহলে তারা হাসিল বা চার্জ বেশি পাবে। মানুষ যদি বাস্তব দুনিয়ায় বসে থাকে, তবে তাদের কোন লাভ হবে না। তাই কথিত ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের নামে মানুষকে তারা নানান কায়দায় ডিভাইসমুখী করে তাদের হাট বা আড়তে নিয়ে আসতে চাইছে।

 লক্ষ্য করবেন, বাস্তব দুনিয়াতে আমরা সমাজ বলতে বুঝি এমন একটি স্থান, যেখানে অনেক মানুষ একত্রে বসবাস করে, যেখানে নিজস্ব নিয়ম-কানুন প্রথা সংস্কৃতি আছে। কিন্তু এই সব ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের লোকরা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে নতুন ভার্চুয়াল সমাজ বানাতে চায়। যেই ভার্চুয়াল সমাজের নাম দিয়েছে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া। মানুষ আগে সমাজের মানুষের সাথে মেলামেশা করতো, গল্প গুজব করতো, সময় কাটাতো। কিন্তু এখন মানুষ বাস্তব সমাজে আর সময় দেয় না। এখন মানুষ তাদের বানানো নতুন ভার্চুয়াল সমাজ, মানে সোশাল মিডিয়ায় সময় দেয়। মেসেঞ্জার চ্যাটবক্স, গ্রুপ, কমিউনিটি করে সেখানে সারাদিন বসে থাকে। ছোট ডিভাইসে মাথা গুজে দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করে। দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় দেয়া লোকগুলো বাস্তব জীবনে অসামাজিক হয়ে ওঠে।

 কথিত ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের হোতারা মানে ফেসবুকের মালিক জুকারবার্গ, মাইক্রোসফটের বিল গেটস কিংবা গুগলের সুন্দর পিচাইরা কিন্তু তাদের নিজ সন্তানদের ডিভাইসে অভ্যস্ত করেনি। মিডিয়ায় বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, এসব টেকনলজি জায়ান্টরা নিজ সন্তানদের ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে দূরে রেখে বাস্তব দুনিয়ায় বেশি অভ্যস্ত করেছে। বাচ্চাদের কেউ ভার্চুয়াল কাজে সংযুক্ত হলেও তাদের সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, পাশে থেকে অবাধ বিচরণে বাধা দিয়েছে।

 দেখা যাচ্ছে, এসব ভার্চুয়াল জগতের হোতারা নিজ সন্তানের জন্য যা পছন্দ করেনি, সেটাই কথিত ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বলে তুলে দেয়া হচ্ছে অন্যদের সন্তানের হাতে। পড়ালেখার নাম করে বাচ্চাদের অভ্যস্ত করা হচ্ছে বিভিন্ন ডিভাইস ও ইন্টারনেটে, যা খুবই বিপদজনক। বিষয়টি নিয়ে প্রতিটি অভিভাবকের সচেতন ও সতর্ক থাকা এবং শিক্ষা কারিকুলামের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা একান্ত জরুরী।

Comments