বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে কিছু কথা

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে কিছু কথা

 বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে কিছু কথা

১. বাংলাদেশে যারা নতুন শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করেছে, তাদের দাবী- এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মুখস্ত না করে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিখবে। কিন্তু বাস্তবে মুখস্ত হ্রাসের কথা বলে বিজ্ঞান বা সাইন্স চ্যাপ্টার-ই হ্রাস করে ফেলা হয়েছে, যা খুবই ভয়ঙ্কর বিষয়।

 ২. যে অভিজ্ঞতাসমূহ শেখানো হচ্ছে, তাও আর্টস নির্ভর, সাইন্স নির্ভর না। অর্থাৎ নতুন কারিকুলামে একজন শিক্ষার্থী আর্টসে অভিজ্ঞ হলেও সাইন্সে অভিজ্ঞ হবে না।

 ৩. দাবী করা হচ্ছে, নতুন ক্যারিকুলামে ছাত্রদের সফট স্কিল (যোগাযোগ ক্ষমতা, নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা, দলগত কাজ করা) বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এ সমস্ত স্কিল কোনটাই সাইন্স নির্ভর স্কিল না। সাইন্স নির্ভর স্কিল বৃদ্ধির জন্য সর্বপ্রথম দরকার ব্যাপক গণিত অনুশীলন। কিন্তু নতুন কারিকুলামে প্রতি ক্লাসে গণিত অনুশীলন ব্যাপকহারে হ্রাস করা হয়েছে। শুধু হ্রাস নয়, বরং ক্ষেত্র বিশেষে গণিত নিয়ে বিভ্রান্তি বা ধোয়াশাও তৈরী করা হয়েছে।

 ৪. সাইন্সের নামে ছাত্রদের যা শেখানো হচ্ছে সেওটা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ- সাইন্স বইয়ে শেখানো হচ্ছে কল্পনায় বিজ্ঞানীর ছবি আকো। কিংবা বিজ্ঞানের কোন বিষয় অভিনয় করে দেখাও। এটা কোন সাইন্স না, এটা আর্টস। নতুন কারিকুলামে সাইন্সের মধ্যে আর্টস ঢুকানোর প্রচণ্ড চেষ্টা হয়েছে। এটাকে কলাবিজ্ঞান বা সিউডোসায়েন্স বলা যায়।

 ৫. দাবী করা হচ্ছে, ‘পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্রে নাকি অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিখন পদ্ধতি আছে। ’ হ্যা, অনেক রাষ্ট্রে আছে, কিন্তু সেসব রাষ্ট্রে মোটেও বিজ্ঞান পাঠ কমিয়ে দেয়া হয়নি।

 ৬. নতুন পদ্ধতিতে দাবী করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে নাকি বেকারত্ব কমবে। কিন্তু বাস্তবে সাইন্সের থেকে আর্টসের ছাত্ররা বেশি বেকার থাকে। এ পাঠ্যক্রমে যেহেতু সাইন্স হ্রাস করে আর্টস বৃদ্ধি করা হয়েছে, তাই এর মাধ্যমে বেকারত্বের পরিমাণ আরো বাড়বে।

 ৭. এ পদ্ধতিতে অবশ্যই মেধা পাচার চূড়ান্ত রূপ ধারণ করবে। দেশে মেধা থাকবে না, যতটুকু থাকবে সেটাও নষ্ট হবে। যাদের আর্থিক সামর্থ বা সুযোগ আছে তারা বিদেশে চলে যাবে এবং সেখানেই সেটেল হবে। তখন দেশের কর্মক্ষেত্রে বিদেশ থেকে আমদানি করা লোকে ভরে যাবে। এমনকি সাধারণ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের ক্ষেত্রেও আমাদের বিদেশীদের উপর নির্ভর করতে হবে। অর্থাৎ এ কারিকুলাম আমাদের স্বাধীন জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরাধীনতার শিকল আরো দৃঢ় করে বাধবে।

 ৮. ২০০৮ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হলো। ২০২৩ সালে তা আবার বাতিল করা হলো। এই যে ১৫ বছর কোটি কোটি শিক্ষার্থীকে গিনিপিগ বানিয়ে একটি ব্যর্থ পদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো, এর দায় কার? যারা সৃজনশীল নামক ব্যর্থ পদ্ধতি চালু করেছিলো, সেটা বাতিল হওয়ার পর তারা কি জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলো? পূর্বের ব্যর্থ পদ্ধতিতে ক্ষমা না চেয়ে নতুন পদ্ধতি দিয়ে ছোট বাচ্চাদের গিনিপিগ বানানো কতটা যুক্তিযু্ক্ত?

 ৯. যারা দেশের বাচ্চাদের উপর নতুন সিস্টেম চাপিয়ে দিতে চাইছে, তাদের কয়জনের বাচ্চা বা নাতি-নাতনি বাংলাদেশের স্কুলে লেখাপড়া করে তার হিসেবে নেয়া দরকার। উদাহরণস্বরূপ- বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর ছেলে ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে লেখাপড়া করেছে, মেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া করেছে। নতুন কারিকুলামের অন্যতম হোতা জাফর ইকবালের পুত্র লেখাপড়া করেছে নেদারল্যান্ডের ইউনির্ভাসিটি অব আমস্টারডাম থেকে, আর কন্যা জন্ম ও বেড়ে ওঠা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, পড়ালেখা করেছে সেখানে কর্নেল ইউনিভার্সিটি এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যাদের এত চিন্তা, যারা অন্যের সন্তানদের উপর নিত্য-নতুন পদ্ধতি চাপিয়ে দিতে চায়, তাদের কয়জনের সন্তান এই সিস্টেমে লেখাপড়া করেছে সেটা আগে জানা দরকার।

 ১০. যত পদ্ধতি চালু করা হোক, বাচ্চাদের শেখাবে শিক্ষকরা। বাংলাদেশের শিক্ষকরাই কি নতুন সিস্টেম বুঝতে পেরেছে ? নতুন কারিকুলাম অনুসারে সরকারের শিক্ষক ট্রেনিং-ই তো শেষ হয়নি। লক্ষ লক্ষ শিক্ষকের ট্রেনিং এখনও বাকি। তার আগেই ৭টি ক্লাসে নতুন পাঠ্যক্রম চালু হয়ে গেছে। আমরা জানি, সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর ১৫ বছর পর জানা গিয়েছিলো, ৪২% শিক্ষক সৃজনশীল সম্পর্কে কোন ধারণাই রাখে না। তাহলে বর্তমানে যে নতুন শিক্ষা পদ্ধতি চালু হলো, তা সম্পর্কে সকল শিক্ষকরা কতটুকু ধারণা রাখে, কিংবা আদৌ তারা সেটা ছাত্রদের উপর প্রয়োগ করতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে আগে গবেষণা করা দরকার। কিন্তু সেটা না করেই আবারও আমাদের সন্তানদের গিনিপিগ বানানো হলো। যা খুবই ভয়ঙ্কর ও জঘন্য।

 

Comments