বর্তমানে দেশকে উন্নত করতে হলে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের বিকল্প নেই

বর্তমানে দেশকে উন্নত করতে হলে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের বিকল্প নেই

 বর্তমানে দেশকে উন্নত করতে হলে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের বিকল্প নেই

-শেখ মুহম্মদ রাফসানযানি

 বর্তমানে বাংলাদেশকে যদি উন্নত করতে হয়, তবে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশ নিজস্ব সম্পদ উত্তোলন করে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তেল, গ্যাস বিক্রি করে তারা এখন বিশ্বের অন্যতম ধনী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার পরও আমরা সেগুলো উত্তোলন করতে পারছি না। নিজেদের প্রয়োজন মেটাচ্ছি বিদেশ থেকে আমদানি করা সম্পদ দিয়ে। ফলে আমরা অর্থ সংকটেই থেকে যাচ্ছি।

 বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের বিপক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। লক্ষ্য করে দেখবেন, দেশের কোন প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করতে গেলেই কিছু এনজিও বা গোষ্ঠী এসে বাধা দিয়ে বলবে, প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করলে পরিবেশ দূষণ হবে। দেখা যায়, এসব এনজিও বা গোষ্ঠীর পেছনে বৈদেশিক ফান্ডিং থাকে। অথচ নিজ দেশের সম্পদ উত্তোলন না করে আপনি যখন নিজ দেশের প্রয়োজন বিদেশ থেকে আমদানি করে মেটাবেন, তখন তারা কিন্তু ‍কিছু বলবে না। অর্থাৎ ঐ এনজিও বা গোষ্ঠীটি দেশের সম্পদ উত্তোলনের বিপক্ষে কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানির পক্ষে। অথচ পরিবেশের কিন্তু দেশ-সীমা নেই। পরিবেশ কথা যদি চিন্তা করতেই হয়, তবে যে কোন দেশ থেকে আমদানি করার বিরোধীতা করা উচিত। কারণ তাদেরও তো পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার কথা। কিন্তু ঐ বিশেষ গোষ্ঠীটি তা করে না।

 আসলে বর্তমানে যে কোন পরিবেশবাদী বয়ান (narrative) পেছনে যতটা না পরিবেশগত স্বার্থ থাকে, তার থেকে বেশি থাকে ভিন্ন কোন স্বার্থ। বিশেষ করে একপক্ষ অন্যপক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে এসব পরিবেশবাদী বয়ান (narrative) দেয়। যেমন, ধরুন ‘বেলা’ নামক একটি বিদেশী পদদপুষ্ট এনজিও পরিবেশের কথা বলে সিলেট বিভাগ থেকে পাথর ও বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য কাজ করছে। কিন্তু সিলেটে পাথর উত্তোলন বন্ধ করলেও তো বিভিন্ন নির্মাণ কাজে পাথরের প্রয়োজন আছে। সেই পাথর আমদানি করা হচ্ছে ভারত বা ভুটান থেকে। ফলে সেখানকার ব্যবসায়ীরা উপকৃত হচ্ছে। আবার দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা মানেই ডলার ব্যবহার। আমরা জানি ফিয়াট কারেন্সি মার্কিন ডলারের দাম নির্ভর করে চাহিদা-যোগানের উপর। আমেরিকা বিশ্বজুড়ে প্রচুর খরচ করে, বিশেষ করে ইসরাইল-ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকা খরচ করছে। কিন্তু সেই খরচ মেটাতে গিয়ে আমেরিকার ডলারের দাম নেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই নেমে যাওয়া বন্ধ করতে আমেরিকা চাইবে ডলারের চাহিদা অব্যাহত রাখা। আর সেই চাহিদা বজায় থাকবে, যখন আমরা প্রচুর পরিমাণে বিদেশ থেকে আমদানি করবো। আমরা যদি আমদানি বন্ধ করে দিতাম, তবে ডলার তার মূল্যমান ঠিক রাখতে পারতো না। অর্থাৎ আমরা দেশের সম্পদ উত্তোলন না করে যত বিদেশ থেকে আমদানি করবো, তত আমরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হবো এবং আমেরিকা তত অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে, যা টিকিয়ে রাখবে মার্কিন সম্রাজ্যবাদকে।

 আবার প্রতিনিয়ত ভারতের মেঘালয় থেকে প্রাকৃতিকভাবে পাথর ও পলি এসে সিলেটের নদীগুলো ভরাট করে দিচ্ছে। পাথর বা বালু উত্তোলন বন্ধ থাকায় সিলেটের নদীগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে। এতে বর্ষাকালে ভারত থেকে সামান্য ঢল নেমে আসলেই নদী উপচে বন্যা ঘটে। ২০২২ সালে সিলেট বিভাগে যে ভয়াবহ বন্যা হয়, তার অন্যতম কারণ ছিলো নদী থেকে পাথর বা বালু উত্তোলন বন্ধ করা। অর্থাৎ পরিবেশবাদীরা পরিবেশের কথা বলে পাথর উত্তোলন বন্ধ করলেও বাস্তবে পাথর উত্তোলন না করাই ছিলো সিলেট বিভাগের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

 আবার বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে কলয়া সম্পদ রয়েছে। কিন্তু সেই কয়লাও উত্তোলন করতে দেয়া হয় না। বাংলাদেশে কয়লা সম্পদ উত্তোলন বন্ধ হয় ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। যেখানে বামপন্থী পরিবেশবাদীরা পুলিশের সাথে মারামারি বাধায়। পুলিশের গুলিতে সেই সময় ৩ জন নিহত এবং ২০০ জন আহত হয়। এই ঘটনাকে পূঁজি করে বাংলাদেশের কয়লা উত্তোলন প্রায় নেই করে দেয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে প্রচুর পরিমাণে কয়লা লাগে, যার প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে। অথচ ইউরোপ-আমেরিকা-চীন-ভারত নিজ দেশের কয়লা দিয়ে ভালোভাবেই চলছে। তাদের পরিবেশের কোন ক্ষতি হয় না। ক্ষতি হয় শুধু বাংলাদেশের পরিবেশের।

 উল্লেখ্য, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কয়লা খনি ধরা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইয়োমিং এর নর্থ অ্যান্টিলোপ রোশেলের কয়লা খনিকে। সেখানে কয়লার উত্তোলনযোগ্য মজুদ ১৭০ কোটি টন। অপরদিকে, বাংলাদেশের জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে সম্ভাব্য কয়লার মোট মজুদ ৫৫০ কোটি টন। এর এক-তৃতীয়াংশও যদি উত্তোলন করা যায়, তবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কয়লা মজুদ রয়েছে এক জয়পুরহাটের জামালগঞ্জেই, দেশের বাকি কয়লা খনিগুলো তো রয়েই গেলো। আরো উল্লেখ্য করার মত বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের কয়লা পৃথিবীর যে কোন দেশের কয়লা থেকে উন্নত। যেমন- জামালগঞ্জের কয়লার ক্যালোরিফিক ভ্যালু বা শক্তি উৎপাদনক্ষমতা ১২ হাজার ১০০ বিটিইউ/পাউন্ড। এ ধরনের কয়লার গঠন শুরু পারমিয়ান যুগে (২৫ কোটি বছর আগে)। অত্যন্ত উচ্চমানের এ কয়লায় সালফারের পরিমাণ খুবই সামান্য। ফলে এ কয়লা ব্যবহারে পরিবেশদূষণ কম হবে। (তথ্যসূত্র: বনিকবার্তা, অক্টোবর ২৯, ২০২২)

 এবার আসি বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ নিয়ে। ২০১৪ সালের ১৪ই নভেম্বর আমেরিকা ভিত্তিক অনলাইন ম্যাগাজিন দ্য ডিপ্লোমেট বাংলাদেশে গ্যাস সম্পদ নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপায়। যার শিরোনাম ছিলো Bangladesh: Asia’s New Energy Superpower? প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, এশিয়ার অন্যতম জ্বালানি শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ অবস্থান করছে। পরবর্তী প্রাকৃতিক গ্যাসের সুপার পাওয়ার হবে দেশটি। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ভারতের সাথে বিরোধপূর্ণ সমুদ্র এলাকায় ২০ হাজার স্কয়ার কিলোমিটারে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমুদ্রসীমায় রয়েছে প্রাকৃতিক জ্বালানি সম্পদের অভাবনীয় সম্ভাবনা। সান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়ার গবেষক ও জার্নালিস্ট জ্যাক ডেচ এক কলামে লেখে, এই মুহূর্তে ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস মজুদের একটি হিসাব কষা হচ্ছে যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্ব বৃহৎ সরবরাহ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পেট্রোবাংলা এই বছরের শেষে ১৮টি নতুন তেল ও গ্যাস ব্লকের নিলাম ডাকে। সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের পলিসি অ্যাসোসিয়েট নেইল ভাতিয়া বলে, পৃথিবীর ভেতর বাংলাদেশ হবে সেরা গ্যাস সমৃদ্ধশালী দেশ। মানার এনার্জির হেড অফ কনসাল্টিং রবিন মিল জানায়, প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশের এই সীমানায় কতটুকু গ্যাস রয়েছে তা এখনো প্রমাণিত নয়। ১০০ কী ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস মজুদ থাকতে পারে। বাংলাদেশকে ইঙ্গিত করে সে আরো জানায়, তবে আমরা নতুন একটি গ্যাস অঞ্চল আবিষ্কার করতে যাচ্ছি। (দ্য ডিপ্ল্যোমাট, ১৪ নভেম্বর, ২০১৪)

তবে শুধু সমুদ্র নয়, বাংলাদেশের ভেতরেও রয়েছে প্রচুর গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভবনা। এক সিলেটের ছাতক গ্যাস ফিল্ডে ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদের সম্ভবনা রয়েছে। (তথ্যসূত্র: যুগান্তর, ১৪ আগস্ট ২০১৮)

 বাংলাদেশে এত গ্যাস সম্পদ থাকার পরও তা উত্তোলন করা হয় না, বরং কোটি কোটি ডলার খরচ করে তরল (এলএনজি) গ্যাস আমদানি করা হয়। এ সম্পর্কে গত ২৬ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো একটি প্রতিবেদন করে, যার শিরোনাম ছিলো, “চুক্তি হচ্ছে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে, ১৫ বছর ধরে এলএনজি কেনা হবে।” এছাড়া বাসাবাড়ির রান্নার জন্য এলপিজি গ্যাসও আমদানি করা হয় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে। বিদেশ থেকে আমদানি করা উচ্চমূল্যের গ্যাসের ব্যবহার করতে গিয়ে দেশের মানষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। অথচ দেশের গ্যাস উত্তোলন করলে বিদেশী উচ্চমূল্যের গ্যাস আমদানি করা লাগতো না।

 গ্যাস ও কয়লা ছাড়া বাংলাদেশে এখন তেলের খনিও মিলছে। ২০২৩ এর ডিসেম্বরে সিলেটে তেলের খনির সন্ধান পাওয়া যায়। (তথ্যসূত্র: বিবিসি, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩)

 কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদই আছে। কিন্তু সেগুলো যদি উত্তোলন না করে, বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটাই তাহলে আমরা কখনই আমাদের দেশের অবস্থা পরিবর্তন করতে পারবো না। বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রগুলো যেখানে তেল-গ্যাস-কয়লা উত্তোলন করে নিজের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করছে, সেখানে আমরা মাটির তলায় সম্পদ লুকিয়ে রেখে কত দিন কষ্ট করবো?

 লক্ষ্য করে দেখবেন, বাংলাদেশে রাস্তাঘাট-ব্রীজ ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, সেতু বানিয়ে দেশের উন্নয়ন দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এসব উন্নয়ন দিয়ে কিন্তু দেশের জনগণের খরচ কমছে না, বরং বাড়ছে। কিন্তু এই টাকাগুলো যদি এসব প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনে ব্যবহার হতো, তবে এসব সম্পদ দিয়ে দেশের খরচ মিটিয়ে প্রয়োজনে বিদেশ রফতানি করে আয় বাড়তো। ডলারের ব্যবহার কমিয়ে দিলে আমাদের মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেতো এবং দ্রব্যমূল্য আরো কমতো। দ্রব্যমূল্য কমানো হতো আসল উন্নয়ন।

 তাই দেশকে উন্নত করার অন্যতম উপায় হতে পারে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করে দেশের প্রয়োজন দেশের সম্পদ দিয়ে মেটানো এবং আমদানি শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আসা। পাথর-বালু-তেল-গ্যাস-কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশকে কখনই উন্নত করা যাবে না।

 

Comments