বছরে লক্ষ লক্ষ হাফেজ-মাওলানা বের হলেও সমাজে কেন অপরাধ কমে না?

Comments · 2120 Views

বছরে লক্ষ লক্ষ হাফেজ-মাওলানা বের হলেও সমাজে কেন অপরাধ কমে না?

বছরে লক্ষ লক্ষ হাফেজ-মাওলানা বের হলেও সমাজে কেন অপরাধ কমে না?

-মুহম্মদ গোলাম সামদানি

 বর্তমানে মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে। কিশোর থেকে বৃদ্ধ সব বয়সেই বেড়েছে অপরাধ প্রবণতা। রাষ্ট্র অপরাধ দমনে আইন, কানুন, জেল-জরিমানা, কয়েদখানা-জেলখানা বাড়াচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই যেন অপরাধ কমছে না।

 অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছে অপরাধ বৃদ্ধির কারণ সমাজে নীতি (ethics), নৈতিকতা (morality), আদব বা শিষ্টাচার (Etiquette), ভদ্রতা (manner) ইত্যাদির চর্চা উঠে যাচ্ছে। তারা বলছে, এগুলোর চর্চা সমাজে ফিরিয়ে আনলে অপরাধ কমে যাবে। কিন্তু এসব চর্চা কিভাবে মানুষের মাঝে ফিরে আসবে, কিভাবে মানুষ তা নিজের মধ্যে ধারণ করবে, সে সম্পর্কে তারা বলতে পারছে না।

 আমরা যারা ধার্মীক আছি, আমরাও মুখস্ত বলি, সমাজে ধর্ম চর্চা বাড়ালে নীতি নৈতিকতা বৃদ্ধি পাবে, আর নীতি নৈতিকতা বাড়লে অপরাধ বোধ কমে যাবে। কিন্তু আসলেই কি সমাজে ধর্ম চর্চা নেই? লক্ষ লক্ষ মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজ হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসায় বাচ্চারা কোরআন হাদীস শিখছে। প্রতি বছর কয়েক লক্ষ হাফেজ আর কয়েক লক্ষ কামেল মাওলানা বের হচ্ছে। ওয়াজ মাহফিলেরও অভাব নেই। এক বক্তার থেকে অন্য বক্তার গলায় সুর বেশি, ফেসবুক ইউটিউবে ফলোয়ার বেশি, ঘন্টায় মিলিয়ন ভিউ হচ্ছে। এতই যখন ধর্মচর্চা তাহলে সমাজে কেন নীতি নৈতিকতা তৈরী হচ্ছে না? কেন অপরাধ কমছে না?

 আসলে দ্বীন ইসলামে জ্ঞান বা শিক্ষাকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে-

১. ইলমে ফিকহ।

২. ইলমে তাসাউফ।

 এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন, “তিনি (রাসূল) তাদেরকে আপনার কিতাব তেলাওয়াত করে শোনাবেন আর তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের তাজকিয়া (অন্তর পরিশুদ্ধ) করবেন।" (সুরা বাকারা : ১২৯)

এ আয়াত শরীফ অনুসারে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা হচ্ছে ইলমে ফিকহ আর তাজকিয়া বা অন্তর পরিশুদ্ধ করা হচ্ছে ইলমে তাসাউফ।

 মূলতঃ আমরা মসজিদ মাদ্রাসায় দৃশ্যত যে শিক্ষা দেখতে পাই, ওয়াজ মাহফিলে যে আলোচনা হয়, এগুলো হলো ইলমে ফিকহের সামান্য অংশ বিশেষ।

অপরদিকে ইলমে তাসাউফ হচ্ছে অন্তর পরিশুদ্ধের জ্ঞান, যার মাধ্যমে বাস্তবিক অর্থে নীতি নৈতিকতা শেখা যায়। আর এই শিক্ষাটা কোন বই পড়ে পাওয়া যায় না, এই শিক্ষাটি কোন ওলী আল্লাহ বা পীর সাহেবের কাছে গিয়ে শিখতে হয়।

সমস্যা হচ্ছে, আমরা মসজিদ-মাদ্রাসায় শিক্ষা দেয়া ইলমে ফিকহের সামান্য অংশবিশেষকেই সবকিছু মনে করি। কিন্তু ইলমে ফিকহের যে আরো অংশ রয়ে গেছে, এবং ইলমে তাসাউফ নামক নীতি নৈতিকতা শেখার আলাদা একটি শিক্ষা রয়ে গেছে সেটা জানিও না, অর্জনের চেষ্টাও করি না। আর এজন্যই সমাজে প্রচুর হাফেজ-মাওলানা-ওয়ায়েজ বের হলেও নীতি নৈতিকতা বাড়ে না, বরং ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়।

 আসলে ইলমে তাসাউফের মূল শিক্ষাই হচ্ছে নীতি (ethics), নৈতিকতা (morality), আদব বা শিষ্টাচার (Etiquette), ভদ্রতা (manner) শেখানো। মানুষের মনকে মন্দ আচরণ থেকে দূরে সরিয়ে ভালো আচরণের মধ্যে নিয়ে আসা। এর মাধ্যমে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে পবিত্র করা, এবং সেই পবিত্র অন্তর দিয়ে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য লাভ করা। তবে এ বিষয়গুলো কোন বই পড়ে লাভ করা যায় না, বরং একজন হক্কানী ওলী আল্লাহ বা পীর সাহেবের সাহচার্যে থেকে যিকির-ফিকির করতে হয়, মুরাকাবা ও মুজাহাদা করতে হয় এবং ব্যবহারিক জ্ঞান থেকে অর্জন করতে হয়।

ইতিহাস বলে, ইসলামের শুরুর সময় থেকেই মুসলমানদের মধ্যে এই অন্তর পরিশুদ্ধির জ্ঞান বা ইলমে তাসাউফের চর্চা ছিলো। এজন্য মুসলমানদের নীতি, নৈতিকতাও সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিলো। তখন কম সংখ্যক মুসলমান অধিক সংখ্যক কাফিরের উপর প্রাধান্য লাভ করতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে মুসলমানরা ইলমে তাসাউফ চর্চা হারিয়ে ফেলে। ফলে নীতি নৈতিকতার ঘাটতি দেখা যায়, আর তখনই মুসলমানদের পরাজয় ঘটতে থাকে। অধিক সংখ্যক মুসলমান হয়েও কম সংখ্যক কাফিরের নিকট পরাজিত হয়। বিশেষ করে গত ১০০ বছরে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে।

কারণ মুসলমানদের মধ্যে কিছু কিছু গোষ্ঠী ইলমে তাসাউফ চর্চা বা পীর সাহেব ওলী আল্লাহগণের কাছে যাওয়ার বিরুদ্ধে ফতওয়া দেয়। ফলে ওলী আল্লাহ বা পীর সাহেবগণ থেকে দূরে সরে মুসলমানদের মধ্যে নীতি নৈতিকতার চরম অবক্ষয় সৃষ্টি হয়। এতে মুসলমানরা কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তো দূরের কথা, উপরন্তু নিজেরাই কাফির মুশরিকদের অনুসরণ করে নানান অনৈতিকতায় যোগদান করে, বিভিন্ন অপকর্ম ও অপরাধের সাথে যুক্ত হয় সমাজে বিশৃঙ্খলতা ‍সৃষ্টি করে। বর্তমানে এ অবস্থা চরম পর্যায়ে পৌছেছে।

এজন্য সমাজে নীতি নৈতিকতা ফিরিয়ে এনে অপরাধ হ্রাস করার একমাত্র সমাধান হচ্ছে, সর্বস্তরে ইলমে তাসাউফ চর্চা প্রণয়ন করা। একজন হক্কানী ওলী আল্লাহ বা পীর সাহেবের কাছে গিয়ে যিকির ফিকির করে অন্তর পরিশুদ্ধ করা, তখনই সমাজ থেকে প্রকৃত অর্থে অপরাধ হ্রাস করা সম্ভব। আবার অপরাধ হ্রাসের সাথে মুসলমানদের নীতি নৈতিকতা ফিরে আসলে মুসলমানদের ঈমানী শক্তিও বাড়বে, আর ঈমানী শক্তি বাড়লে শত্রুর সাথে মুসলমানরা পুনরায় জয়ী হতে পারবে, পুরনায় ফিরে আসবে মুসলমানদের স্বর্ণযুগ, ইনশাল্লাহ।

Comments