শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদে মিলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম কেন উদযাপন করা প্রয়োজন?
লেখা: আব্দুল্লাহ জুবায়ের
আমার ক্ষুদ্র জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় আমি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ইসলাম শিক্ষা পড়িয়েছি। ইসলাম সম্পর্কে জানাশোনার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অবস্থা ভয়াবহ রকমের খারাপ। অভিভাবকদের অবস্থা ততোধিক খারাপ। তারা যেকোনোভাবে ছেলে-মেয়েদের নানা ধরনের কোচিংয়ে দিয়ে হাতের লেখা ভালো করাবে, ছায়ানটে দিয়ে গান শেখাবে-নাচ শেখাবে, ছবি আঁকা শেখাবে, তায়কোয়ান্দো নয়তো কারাতে ক্লাবে সেলফ ডিফেন্স শেখাবে এবং ফি বছর রেড বেল্ট-ব্লাক বেল্ট ইত্যাদি প্রাপ্তির সংবাদ গর্বের সাথে শেয়ার করবে, ম্যাথ-ফিজিক্স-ইংলিশ-কেমিস্ট্রি ইত্যাদি বিষয়ের আলাদা কোচিং করাবে, বাসায় আলাদা আলাদা গৃহশিক্ষক রাখবে এসব বিষয় দেখভাল করানোর জন্য দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা নিদারুন অধ্যবসয়ের সাথে ছেলেমেয়ের পেছনে লেগে থাকবে। কিন্তু ইসলামের বেলায়, রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানার বেলায় এবং মানতে শেখানোর বেলায় লবডঙ্কা।
দ্বীন ইসলামকে বুঝতে হলে এবং এর আবেদন অনুভব করতে হলে আগে আখেরী নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্ণ জীবন (শুধু চল্লিশ পরবর্তী জীবন নয়) বুঝতে হবে, জানতে হবে। এরপর ইসলাম মানার প্রশ্ন। যাঁর হাত ধরে ইসলাম এসেছে, তাঁকে বিশ্বাস করি বলেই আমি ইসলাম মানি। তাঁকে বিশ্বাস করি বলেই আমি আল্লাহর উপর বিশ্বাস আনতে পেরেছি। বিশ্বাস আর আস্থা আসে ভালোবাসার হাত ধরে। একজন মানুষকে যথার্থভাবে ভালো না বাসলে তাঁর উপর পরিপূর্ণভাবে আস্থা রেখে গায়েবে বিশ্বাস করা কঠিন। অনেক বেশি দুঃখিত হয়ে খেয়াল করলাম- যেসব শিশুদের পড়াই, তাদের বাসায় ধর্মীয় কোনো কার্যক্রম নাই। বাবা-মায়েরা তাদের আখেরী নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জীবনী শোনায় না, নাম ছাড়া তাঁর জীবনের তেমন কিছুই তাঁরা জানে না। অথচ তাঁর অনুসারী হয়ে বসে আছে!
এইসব শিশুদের রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী যখন বলতাম (পাঠ্যবইয়ের সেই সীমিত গণ্ডির ভেতরে থেকে), তখন দেখতাম তারা নিতান্ত উৎসুক হয়ে শুনছে। পরে তারা বলতো, স্যার! নবীজীর কথা শুনবো। এরা নিষ্পাপ। তাই স্বভাবগতভাবেই সত্যের আর সুন্দরের প্রতি এদের আকর্ষণ। এজন্য তারা অল্পতেই রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে।
কিন্তু মিডটার্ম, অর্ধবার্ষিক, বার্ষিক, এই বন্ধ-সেই বন্ধ-এর ফাঁকে কতটুকুই বা ক্লাস চলে। ফি বছর আমাকে আখেরী নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেনাতে না পারানোর অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে ছাত্রদের বিদায় জানাতে হয়। নতুন ক্লাস আসে। নতুন বই আসে। আমরা আকীদা, নামাজের নিয়ম, রোযার নিয়ম, হজের নিয়ম এসব পড়াই সাথে সাথে। কিন্তু আমি নিজেও জানি, এরা বাসায় ফিরে অন্য কোনো বই নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়বে, নাকে মুখে কিছু গুঁজে দিয়ে তাদের মায়েরা তাদেরকে কোচিংয়ে নিয়ে যাবে এবং অতি অবশ্যই সেটা ইসলাম রিলেটেড কোনো কিছু হবে না।
মরুভূমির মতো এই খাঁখাঁ পরিবেশে ঈদে মিলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটা মাত্র উপলক্ষ্য তাঁকে জানার, তাঁকে জানানোর। একবার স্যারদের সাথে মিলে আলোচনা করি- এবারের ঈদে মিলাদুন্নবীতে কোনো সীরাতের বই পাঠ প্রতিযোগিতা করা যায় কি না। কিংবা কোন কোন প্রশ্ন কুইজে রাখা যায়? উপহার হিসেবে কোন কোন সীরাতের বই দেয়া যায়? বক্তব্য কারা রাখবে বার্ষিক মিলাদে? তাঁর পবিত্র সীরাতের কোন অংশ কে বলবে? রচনা প্রতিযোগিতায় কোন গ্রুপে কী বিষয় দেয়া যায়?
আমরা অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে ক্লাসে ক্লাসে ঘুরি। ছেলেমেয়েদের বলে দেই, অমুক দিন আসো। হামদ-নাতের অডিশন। বিচারকের আসনে বসে যাই। খাঁটি বোদ্ধাদের মতো মাথা নাড়ি। আড়চোখে অন্যরা কি দেখেছে, তা দেখে বাড়িয়ে নম্বর দিয়ে দেই।
যে ছেলেটা, যে মেয়েটা বেশিরভাগ সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়তো অন্য কোনো সঙ্গীত গায়, সেও এবারে দরাজ কণ্ঠে নজরুলের হেরা হতে হেলেদুলে নুরানী তনু কে আসে হায় গাওয়া শুরু করে। ভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীরাও দরদ নিয়ে নাতগুলো গাইতে থাকে।
রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চর্চার এই সুযোগটা দেখে রোমাঞ্চিত হই, চোখে পানি আসে। সারা বছর ক্লাসে গলা ভেঙে যেটা করতে পারি নাই, মাত্র কয়েক দিনের প্রোগ্রামে তার চেয়ে বেশি ছেলেরা নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানতে পারে। জানানোই সবচেয়ে বড় দাওয়াত। আখেরী নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে সত্যিকারভাবে চিনতে পারে, তার আর কোনো কিছু বাকি থাকে না।
এরপর আসে ফতোয়া পার্টি- এহ! মিলাদুন্নবী বিদাত। ছ্যাহ! ছ্যাহ! আরে তোরা তো মাজারপূজারী, বিদাতের জন্য জাহান্নামে যাবি ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের দেখে আবু লাহাবের কথা মনে হয়। রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বিভিন্ন গোত্রের কাছে ইসলামের মর্মার্থ তুলে ধরতেন, আবু লাহাব পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতো। তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে হাজির হতো। তাঁর কথা শেষ হতেই আবু লাহাব বলে উঠতো- লোকেরা এর কথা শুনো না। এ হলো মিথ্যাবাদী।
আমার এজন্য মনে হয়, নবীজীকে জানা ও চর্চার এত বড় একটা সুযোগের গোড়ায় যারা পানি ঢেলে দেয়, তারা কোনো না কোনোভাবে হয়তো অবচেতনভাবে আবু লাহাবের চেতনায় প্রভাবিত।