ইসরাইলে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের ‘তুফানুল আকসা’ অভিযানের যৌক্তিকতা
লেখা : মুহম্মদ ইনজামামুল
২০২৩ সালের আগস্ট মাসের ৭ তারিখে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা শহর থেকে, ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত ফিলিস্তিনের বিভিন্ন শহরে হামলা চালায় হামাস নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগঠন। ফিলিস্তিনকে দখলমুক্ত করার জন্য এই দুঃসাহসী অভিযানের নাম দেওয়া হয় `তুফান আল আকসা অভিযান`। দখলদারদের দেওয়াল ভেঙ্গে ফেলে স্থল, আকাশ এবং নৌপথে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা দখলকৃত ফিলিস্তিনের একাধিক শহরে ছড়িয়ে পড়ে, এবং সফলভাবে সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলা করে দুশমনদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে, শতাধিক দখলদারদের আটক করে গাজায় ফেরত নিয়ে আনেন।
পৃথিবীর গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসে এই অভিযানটি একটি সফল এবং নিখুঁত গেরিলা অভিযান হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। কিন্তু তারপরও অনেকের মধ্যে এই অভিযান নিয়ে নানান বিভ্রান্তি আছে। কেউ কেউ বলছে, এই অভিযানটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল, এই অভিযানের কারণে ফিলিস্তিনিদের কে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে।
এই বক্তব্যের সমাধান দেয়া হবে এই লেখার মাধ্যমে।
সামরিক বিজ্ঞানের মতে যুদ্ধ মূলত দুই প্রকারের হয়ে থাকে একটি হল কনভেনশনাল। আরেকটি হলো আন-কনভেনশনাল। কনভেনশনাল যুদ্ধ হয় সেই সকল সামরিক বাহিনীর মধ্যে যাদের অস্ত্রশস্ত্র, সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণ সমান সমান বা বরাবর হয়ে থাকে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে যদি কোনদিন যুদ্ধ লাগে তাহলে সেই সকল যুদ্ধ হবে কনভেনশনাল, পাক ভারত যুদ্ধের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একই। কিন্তু যখন দেখা যায় যে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে একটি বাহিনীর অস্ত্র এবং সরঞ্জাম অন্য বাহিনী থেকে অত্যাধুনিক এবং ব্যাপক তখন সেই যুদ্ধক্ষেত্র টা আর কনভেনশনাল হিসেবে গণ্য হয় না তখন সেই যুদ্ধক্ষেত্র টা হয়ে যায় আন-কনভেনশনাল। তার মানে এখন যেই বাহিনীর কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে সামরিক সরঞ্জাম এবং অস্ত্র মজুদ নেই তারা এই ঘাটতিটা পূরণ করার জন্য ভিন্ন উপায় বা রাস্তা ব্যবহার করবে এবং করে থাকে। এই সকল যুদ্ধকে আন-কনভেনশনাল যুদ্ধ বলে, যেমন- গেরিলা যুদ্ধ এক প্রকার নন-কনভেনশনাল যুদ্ধ।
যে দেশকে দখলদার ইসরাইলিরা দখল করে রেখেছে সেই দেশকে আমরা ফিলিস্তিন নামে চিনি। এই দেশটি ইজরাইলিরা ধিরে ধিরে দখলে নিয়ে নেয় এবং দখলে নিয়ে নেওয়ার পর ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে সব ধরনের অধিকার কেড়ে নেয়। বিভিন্ন অধিকারের মধ্যে একটি অধিকার হচ্ছে সামরিক বাহিনী তৈরি করার অধিকার, যা করা হয় নিজেদের আত্মরক্ষা স্বার্থে। এমন অবস্থায় দখল হওয়া ফিলিস্তিনরা নিজেদের দেশকে এবং নিজেদের জীবন রক্ষা করার জন্য যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধ করবে এটাই স্বাভাবিক।
ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একটি শহর দখলমুক্ত করে নিজেদের দখলে রাখাটা কঠিন, কারণ তাদের কাছে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র এবং সরঞ্জাম নেই। কিন্তু তারা যে কাজটা করতে পারবে সেটা হলো দুশমনদের একটা ঘাটিতে বা শহরে হামলা করে ক্ষয়ক্ষতি করে অথবা আটক করে নিজেদের ঘাঁটিতে ফেরত চলে আসা। এটাই গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম। কিন্তু এই কথাটা বলার থেকে করাটা অনেক বেশি কষ্টসাধ্য এবং দুঃসাহসিক।
কারণ আমাদের মাথায় রাখতে হবে গাজা অঞ্চলটি চারদিক থেকে অবরুদ্ধ, একদিকে মিশরের সাথে সীমান্ত থাকলেও মিশরীরা ইসরাইলিদের ভয়ে সীমান্ত অঞ্চলে অবরুদ্ধ করে রাখে। গাজার থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তা নাই। একদিকে আছে সমুদ্র যেটা দখলদাররা নৌবাহিনী দিয়ে দখল করে রেখেছে আর দুই দিকে হচ্ছে ইসরাইলের সীমান্ত যেখানে উচু দেওয়াল দেওয়া এবং সেই দেওয়ালের উপরে লাগানো থাকে রিমোট কন্ট্রোল মেশিন গান যে কেউ ওই দেওয়ালের কাছে আসলেই সেই মেশিনগানের মাধ্যমে তাদেরকে হত্যা করে দখলদার বাহিনী। এই দেওয়ালটার পরেই রয়েছে দখলদার বাহিনীর একাধিক ঘাঁটি এবং এই ঘাঁটির পরে কমিউনিকেশন টাওয়ার রয়েছে যে টাওয়ারের মাধ্যমে অন্যান্য বড় বড় ঘাঁটির সাথে ওয়ারলেসের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে বার্তা আদান প্রদান করা হয়।
৭ আগস্ট, ২০২৩ তারিখ ভোরবেলা ‘তুফানুল আকসা` অভিযান শুরু হওয়ার সাথে সাথে ড্রোন হামলার মাধ্যমে কমিউনিকেশন টাওয়ার গুলি ধ্বংস করে দেয় যার কারণে দেওয়ালের পেছনে অবস্থিত ইসরাইলি বাহিনীর সাথে মূল সেনাবাহিনীর সংযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর পরে ড্রোন হামলা করে মুক্তিযোদ্ধারা দেওয়ালের উপরে অবস্থিত মেশিনগান গুলি ধ্বংস করে ফেলে। শুরু হয় বিস্ফোরক দিয়ে দেওয়াল ধ্বংস করার কাজ, দেওয়াল ধ্বংস হয়ে গেলে দেওয়ালের পিছে থাকা সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলা শুরু করে মুক্তিযোদ্ধারা। দখলদার ইসরাইলের সেনাবাহিনী পৃথিবীর সবচেয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলেও ফিলিস্তিনিদের এই হামলায় মুখ থুবড়িয়ে পড়ে।
দখলদার ইসরাইলের সেনাবাহিনীর উপবাহিনী `গাজা ডিভিশন` মূলত গাজাকে অবরুদ্ধ রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এই পুরো ডিভিশন ধ্বংস হয়ে যায় নেতৃত্বে থাকা জেনারেলদের আটক করে নিয়ে যায় ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধারা।
সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলার পরে মুক্তিযোদ্ধারা দখলদার বসতিগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সেখান থেকে শতাধিক দখলদারদের আটক করতে সফল হয়। ক্ষুদ্র অস্ত্রওয়ালা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এরকম দাপটে বাহিনীর পরাজয়ের নজির আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও পাওয়া যাবে না। তাই এই গেরিল অভিযানের সামরিক সার্থকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে বোকামি।
এরপরে অনেকে বলে থাকেন যে এই অভিযানের কারণে দখলদার ইজরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে, এই অভিযান না হলে ফিলিস্তিনিরা মারা যেত না। তাদের জেনে রাখা উচিত, এই অভিযানের আগেও প্রতিবছর কয়েকশো ফিলিস্তিনি দখলদারদের হাতে মারা যান, হাজার হাজার ফিলিস্তিনিদের কে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়, শুধু তাই নয় অসম্মান এবং ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ মসজিদুল আল আকসা কে। আমরা জানি মসজিদ আল আকসা শরীফকে নি:শেষ করে মন্দির বানানোর জন্যই ইহুদীরা এই অঞ্চলে এসেছে এবং তার প্রতিরোধ করার জন্য ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধারা এই অভিযান শুরু করেছে যা তারা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়ে বলে দিয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের জন্য দায় শুধু হত্যাকারীর। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংগালি মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ করার কারণে বাংগালিদের হত্যা করার দায় যেমন শুধুই পাক হানাদার বাহিনীর, ঠিক সেভাবে ফিলিস্তিনি গণহত্যায় শুধুমাত্র দখলদার ইসরাইলিরাই দায়ী। একটি নির্যাতিত এবং নিপীড়িত জাতির মুক্তির জন্য যুদ্ধ করা তাদের অধিকার।
মনে রাখতে হবে, ২০০৫ সালে দ্বিতীয় ইন্তেফাদার সমাপ্তি হওয়ার পরে এটাই ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় অভিযান। দীর্ঘকাল বড় ধরনের কোন অভিযান না হওয়ার কারণে দুনিয়াব্যাপী সাধারণ জনগণের মধ্যে এই ধারণার জন্ম নেয় যে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাপ্ত হয়ে গেছে। যার কারনে আস্তে আস্তে দেখা যায় বিভিন্ন আরব দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করেছে। ফিলিস্তিনের জনগণের স্বাধীনতার জন্য এটি একটি ভয়ানক পরিণতি। কারণ ইয়াসির আরাফাতের সাথে ইসরায়েলীদের চুক্তি অনুসারে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ১৯৬৭ সীমানায় প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত আরব এবং মুসলিম বিশ্বের কোন দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিবে না, কিন্তু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগেই যদি সব দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করে তাহলে আর ফিলিস্তিন নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে না। বেশ কিছুদিন ধরে আমরা পর্যবেক্ষণ করছিলাম ইসরাইলের সাথে সৌদি আরবদের বিভিন্ন বৈঠকের কথা। সম্ভবত কিছুদিনের মধ্যেই সৌদি আরব ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে দিত। সৌদি আরবের মতন একটি দেশ যদি ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে দেয় তাহলে আস্তে আস্তে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার সরকারও ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করবে। যা হতো ফিলিস্তিন স্বাধীনতার আন্দোলনের জন্য একটি বিপর্যয়। তাই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া থেকেই এ অভিযান, যা ভিন্ন অন্য কোন উপায় ফিলিস্তিনি মুক্তিকামীদের ছিলো না।
তুফান আল আকসা অভিযানের একটি ভুরাজনৈতিক সাফল্য হলো, এই অভিযানের মাধ্যমে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়ার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তার সাময়িকভাবে হলেও বন্ধ করা গিয়েছে। সুতরাং কোন কারণ দেখিয়ে এ অভিযানকে অযৌক্তিক প্রমাণ করার কোন সুযোগ থাকে না।