পরিচয় গোপন করে বিয়ে, সমাধান ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই

Comments · 1136 Views

পরিচয় গোপন করে বিয়ে, সমাধান ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই

 পরিচয় গোপন করে বিয়ে, সমাধান ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই

 -ইঞ্জিনিয়ার মুহম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান

 ২০১৯ সালে বাংলাদেশে এক প্রতারক ধরা পরে। প্রতারকের নাম জাকির। থাকতো টঙ্গীতে। গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট জেলা। তার কাজ ছিলো শুধু বিয়ে করা। ১৪ বছরে মোট ২৮৬ বিয়ে করে সে। জাকির কোন চাকরি বা ব্যবসা করতো না। তবুও দামি দামি পোশাক পড়ে ব্রান্ডের গাড়িতে চড়ে ঘুরে তরুণীদের পটাতে চাইতো।

 গ্রেফতারের পর জাকির পুলিশকে জানায়, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন সময় নিজেকে অবিবাহিত এবং সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতো। তাদের মধ্যে অনেককে সে বিভিন্ন সময় বিয়ে করে। বিয়ের পর জাকির নববধূর বাসায় থাকতো এবং কৌশলে তার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতো। এসব বিয়ের খবর সে কোনো স্ত্রীকে জানতে দিতো না। সবারই ব্যক্তিগত ভিডিও ধারণ করতো। কেউ প্রতিবাদ করলে ওই সব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখাতো। (তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক: ২৪ নভেম্বর ২০১৯)

 শুধু যে পূর্বের বিয়ের কথা গোপন করেই প্রতারণা ঘটে এমনটা না, বরং ধর্ম পরিচয় গোপন করেও বিয়ের ঘটনা ঘটে। যেমন, সম্প্রতি হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুরুষরা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় গোপন করে মুসলিম নামে মুসলিম মহিলাদের বিয়ে করেছে, এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বিয়ের পর ফাঁস হয়েছে পুরুষটি ছিলো আসলে হিন্দু ছিলো।

 গত বছর ২০২৩ সালে রাজশাহীর পুঠিয়ায় এমন একটি ঘটনা ঘটে। সুব্রত ঘোষ নামক এক হিন্দু যুবক সাথী খাতুন (২৪) নামে এক মুসলিম তরুণীকে পরিচয় গোপন করে কাজী অফিসে বিয়ে করে। বিয়ের এক মাস না যেতেই সুব্রত ঘোষ হঠাৎ হওয়া হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন মাধ্যমে তার বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে সুব্রতর বাড়িতে এসে তারা জানতে পারে সে আসলে হিন্দু। (তথ্যসূত্র: দৈনিক ইনকিলাব, ০১ আগস্ট ২০২৩)

 

২০২২ সালেও এমন একটি ঘটনা ঘটে টাঙ্গাইলে। সুভাষ বিশ্বাস এক হিন্দু ধর্মাবলম্বী যুবক কলেজ ছাত্রী হোসনে আরার সাথে ফেসবুকে সম্পর্ক তৈরী করে। অতঃপর সেই সম্পর্কের জের ধরে মাসুদ রানা নামে ভুয়া এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে মুসলিম পরিচয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিয়ের পর ফাঁস হয় মাসুদ রানা নাম ব্যবহারকারী সুভাষ বিশ্বাস আসলে হিন্দু। (দৈনিক যায়যায়দিন, ২৮ জানুয়ারি ২০২২)

 

আসলে বাংলাদেশে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতিতে এমন কিছু ফাক-ফোকর আছে যার মাধ্যমে প্রতারকরা পরিচয় গোপন করে বিয়ে করার সুযোগ পায়। বাংলাদেশে ‍মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয় পত্র/জন্ম নিবন্ধন/এসএসসি সার্টিফিকেট এবং দুই কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি লাগে। কিন্তু এগুলোর মাধ্যমে কোনভাবেই যাচাই করা সম্ভব নয়, একজন মানুষ আসলেই কোন ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে কি না। কেউ হয়ত আগে বিয়ে করতে পারে, কেউ পিতা-মাতা কিংবা স্থায়ী ঠিকানা গোপন রাখতে পারে। আবার কেউ ভুয়া এনআইডি ব্যবহার করতে পারে। সবগুলো বিষয় যাচাই করা আসলে বেশ কঠিন। সম্প্রতি সরকার অনলাইন বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের নিয়ে চিন্তা করছে, কিন্তু বিষয়টি কতটুকু সফলতা পাবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ পরিচয় যাচাই একটা বড় বিষয়, কিন্তু যে ছবি দিয়ে পরিচয় যাচাইয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে, তা মোটেও নির্ভুল পদ্ধতি নয়। আবার কেউ যদি ভুয়া এনআইডি বা অন্যের এনআইডি নম্বর নিয়ে আসে, তবে যাচাই করা কঠিন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে তাহলে সমাধান কি হবে?

 

এই সমস্যার সমাধান হতে পারে কাজী অফিসগুলোতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ের সুবিধা নিয়ে আসা। বিয়েগুলো যদি অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন হয় এবং কাজী অফিসগুলোতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ের সুযোগ থাকে এবং সকল কাজী অফিসগুলো অনলাইনে সংযুক্ত থাকে, তবে কোন ব্যক্তি যদি পরিচয় গোপন করেও কাজী অফিস যায়, তবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেয়ার সাথে সাথে তার আসল পরিচয়, নাম, ঠিকানা, জন্ম তারিখ, ধর্ম পরিচয়, কতটি বিয়ের করেছে, সেই তথ্য বের হয়ে যাবে। ফলে প্রতারকরা প্রতারণা করে বিয়ে করার সুযোগ পাবে না।

 

বাংলাদেশকে এখন বলা হয় স্ম্যার্ট বাংলাদেশ। কিন্তু বাস্তবে পরিচয় যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরে আছে ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতিতে। এখনও ছবি দিয়ে মানুষের পরিচয় যাচাই করা হয় দেশের সকল সরকারী ও বেসরকারী অফিসে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় দুই কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি দিলেই একটা মানুষের সব যাচাই হয়ে গেলো। কিন্তু সেই ছবি দিয়ে কিভাবে অসংখ্য মানুষের মধ্যে এক জনের চেহারা মিলাবে, চেহারা পরিবর্তন হলে কি করবে, দাড়ি-মোছ-চশমা পরলে কি করবে, জমজ বা চেহারার মিল থাকলে কি করবে, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ছবি বানালে কি করবে, দ্বৈত স্থানে দুই পরিচয়ে ব্যবহার করলে সেটা ধরবে কিভাবে কোনটাই ছবি দিয়ে যাচাই করা সম্ভব না। অথচ অনলাইন পদ্ধতিতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই করলে এক মুহুর্তে যে কোন মানুষের তথ্য সঠিকভাবে বের করে আনা সম্ভব। সেখানে ছবি দিয়ে যাচাইয়ের কোন মূল্য নেই।

 

লক্ষ্য করলেন দেখবেন, বাংলাদেশের মাত্র ৫০ টাকার সিম কিনতে গেলেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই করা লাগে। একজনের বৃদ্ধা আঙুলের ছাপ নেয়ার সাথে সাথে সে বলে দেয়, তার নাম-পরিচয়-ঠিকানা কি, তার নামে কয়টি সিমকার্ড আছে। মাত্র ৫০ টাকার সিম কিনতে গেলে যদি এ পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়, তবে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘বিয়ে’র সময় কেন সেই পদ্ধতি চালু করা যাবে না? তখনও আঙুলের ছাপ দেয়ার সাথে সাথে মেশিন বলে দিবে, ব্যক্তির প্রকৃত নাম-ঠিকানা কি, তার ধর্ম পরিচয় কি, সে আগে কয়েকটি বিয়ে করেছে ইত্যাদি।

 

আসলে শুধু বিয়ে নয়, অপরাধী মাত্রই চাইবে পরিচয় গোপন করে অপরাধ করতে। সেক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান হচ্ছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই। মান্ধাতার আমলে ছবি দিয়ে যাচাই অপ্রয়োজনীয় ও অকার্যকর ছাড়া কিছু নয়।

 

Comments