আপনি কি জানেন, যে কোন বিদেশী পণ্য ব্যবহার করা মানেই ইসরাইলকে সাহায্য করা?

আপনি কি জানেন, যে কোন বিদেশী পণ্য ব্যবহার করা মানেই ইসরাইলকে সাহায্য করা?

 আপনি কি জানেন, যে কোন বিদেশী পণ্য ব্যবহার করা মানেই ইসরাইলকে সাহায্য করা?

 সম্প্রতি ইসরাইলপন্থী কোম্পানিদের পণ্য বয়কটের একটা ডাক উঠেছে। ইসরাইলি অথবা ইসরাইলের সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখে এমন কোম্পানির লিস্ট করে তাদের পণ্য বয়কট করার চেষ্টা করছে সবাই। দাবী করা হচ্ছে, এ সকল কোম্পানিগুলো কোন না কোন ভাবে ইসরাইলকে সহায়তা দেয় বা শক্তিশালী করে, যেই শক্তি দিয়ে ইসরাইল ফিলিস্তিনের উপর গণহত্যা চালাচ্ছে, সুতরাং সেই সব কোম্পানির পণ্য বর্জন করতে হবে, এটাই ইসরাইলী গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। নিঃসন্দেহে এ বয়কট আন্দোলন খুব গ্রহণযোগ্য একটি প্রতিবাদ।

 কিন্তু আপনি কি কখনো হিসেব করেছেন, আপনি যে কোম্পানিগুলোর পণ্য বর্জন করছেন, চলমান গাজা সংঘাতে এই সব কোম্পানিগুলোর কত অর্থ সরাসরি ব্যয় হচ্ছে? ইসরাইলি সেনাবাহিনীর যুদ্ধাস্ত্র ক্রয়, প্রযুক্তি সরবরাহ কিংবা ট্রেনিং এ কতটুকু সহায়তা করছে তারা? হিসেব করলে প্রত্যক্ষ সহায়তা হয়ত খুব পাবেন না, পরোক্ষ সহায়তা পেতে পারেন, আর সে কারণেই বয়কট আন্দোলন। কিন্তু যারা গাজায় মুসলিম গন্যহত্যায় ইসরাইলীদের প্রত্যক্ষ সহায়তা করছে, তাদের বেলায় তবে কি করবেন? হ্যা সেই প্রত্যক্ষ সহায়তাদানকারী হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ইসরাইলকে ৩২০ কোটি মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তা দেয়, তবে এবার যুদ্ধ শুরুর পর ১৪০০ কোটি ডলার সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। এছাড়া ইসরাইলের আয়রন ডোমসহ অনেক যুদ্ধাস্ত্র ও ‍গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় পাওয়া।

 অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে ইসরাইলের গণহত্যার সবচেয়ে বড় সহায়তাকারী। আর সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হচ্ছে তাদের মুদ্রা বা ডলার। আপনি সেই ডলার যত ব্যবহার করবেন, তত আপনি ইসরাইলের গণহত্যায় অংশীদার হয়ে গেলেন। ইসরাইলপন্থী কোম্পানি পণ্য বয়কট যেমন জরুরী, তার থেকেও বেশি জরুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলার বর্জন করা।

 বিষয়টি বুঝতে হলে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। আসলে আমেরিকার বর্তমান মুদ্রা ডলার হচ্ছে এক ধরনের ফিয়াট কারেন্সি, যার বিপরীতে কোন সম্পদ বা স্বর্ণ রাখা নেই। শুধুমাত্র চাহিদা ও যোগানের উপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্যমান ধরে রেখেছে আমেরিকা। এখন আমেরিকা যখন ইসরাইলকে ১৪০০ কোটি ডলার সহায়তা করছে, তারমানে সে ১৪০০ কোটি ডলার প্রেসে ছাপিয়ে তা ইসরাইলকে পাঠাচ্ছে। এখন অতিরিক্ত মূদ্রা ছাপানোয় ডলারের যোগান বেড়ে যাচ্ছে, ফলে ডলারের দাম পরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই মুহুর্তে আমি-আপনি যখন বাংলাদেশ থেকে ডলার কিনছি, তখন আবার ডলারের আবার চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে, ফলে ডলারের চাহিদা-যোগান ব্যলেন্স হচ্ছে। এভাবে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে যে দ্বীন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ ধ্বংস করতে যে অর্থ খরচ করছে, সেই খরচ ডলারের মাধ্যমে সারা বিশ্ব থেকে আবার তুলে আনছে। অর্থাৎ আমরা ডলার ব্যবহার করে আমেরিকার সকল অপকর্মে অংশীদার হচ্ছি। বর্তমানে আমেরিকার অপব্যয় বেড়েছে, আর সেই অপব্যয় সামাল দিতে আমাদের দ্রব্যমূল্য মানে চাল-ডাল-তেল-নূনের দামও বেড়েছে।

 তবে আমেরিকা ততক্ষণ মুসলমানদের ক্ষতি করতে অর্থ খরচ করতে পারবে, যতক্ষণ সারাবিশ্বজুড়ে তার ডলারে চাহিদা থাকবে। আর ডলারের চাহিদা তখনই হবে, যখন আমরা প্রচুর আমদানি করবো। আমদানি করা মানে মানে বিদেশী পণ্য ক্রয় করা, সেটা যে দেশেরই হোক না কেন। ইউরোপ-আমেরিকা, ভারত, চীন, মিডলইস্ট কিংবা এশিয়া যেখান থেকেই আমরা পণ্য ক্রয় করি, বাংলাদেশের সীমানার বাইরে থেকে কিছু ক্রয় করতে হলে আমাদেরকে ডলারের স্মরণাপন্ন হতে হয়। এজন্য ভারত থেকে পণ্য কিনতে হলে আমাকে আগে আমেরিকা থেকে ডলার কিনতে হয়, চীন থেকে পণ্য কিনতে হলেও আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডলার কিনতে হয়, মিডলইস্ট থেকে তেল/গ্যাস কিনতে হলে আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডলার কিনতে হয়, অর্থাৎ দেশের বাইরে থেকে কিছু কিনতে হলে আগে আমেরিকা থেকে টাকা দিয়ে ডলার কিনে, তারপর সেই ডলার দিয়ে আরেক দেশ থেকে পণ্য কিনতে হয়ে। অর্থাৎ আমরা যত বেশি বিদেশী পণ্য ব্যবহার করবো, আমদানি নির্ভর হবো, তত বেশি আমেরিকান ডলারের চাহিদা তৈরী হবে, আর যত বেশি আমেরিকান ডলারের চাহিদা তৈরী হবে, আমেরিকা বিশ্বজুড়ে তার অপব্যয়ের খরচ তত পুষিয়ে নিতে পারবে।

 এজন্য দেখবেন, নানান ছুতোয় আমাদেরকে প্রতিনিয়ত আমদানিতে আগ্রহী করা হয়। বাংলাদেশে মাটির নিচে প্রচুর জ্বালানি সম্পদ থাকার পরও সেগুলো তুলতে দেয়া হয় না। যেমন- তেল, গ্যাস, কয়লা এগুলো বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ না করে বিদেশ থেকে আমদানি করতে বলা হয়। এছাড়া বাংলাদেশে প্রচুর পাথর থাকার পরও ভারত থেকে আমদানি করা হয়। এক্ষেত্রে পশ্চিমা ফান্ডিং এ পরিচালিত কিছু বিদেশী এনজিও পরিবেশবাদের নাম দিয়ে কাজ করে। তাদের দাবী আমাদের দেশের কয়লা, পাথর উত্তোলন করলে পরিবেশের ক্ষতি হবে। অর্থাৎ পরিবেশের দোহাই দিয়ে এরা আমদানিতে আমাদের অভ্যস্ত করতে চায়, আর আমাদনি করা মানেই ডলারের চাহিদা তৈরী হওয়া।

 এরপর দেখবেন, আমাদের পশ্চিমা অপসংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করার একটা অপপ্রয়াস সব সময় চলমান থাকে। বিদেশী সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হওয়া মানেই বিদেশী পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি। আর বিদেশী পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি মানেই ডলারের চাহিদা ঠিক রাখা।

 আবার বর্তমানে দৈনিন্দিন ব্যবহার্য পণ্য যেমন আলু, পেয়াজ, ডাল, তেল, গোশত, ফল-ফলাদি সব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসও আমদানি নির্ভর করে ফেলা হচ্ছে। দেশে কৃত্তিম সংকট তৈরী করে দাম বাড়িয়ে আমদানির উপলক্ষ তৈরী করা হচ্ছে, দেশী কৃষক বা উদ্যোক্তাদের ধ্বংস করা হচ্ছে। এখানেও মূল উদ্দেশ্য আমদানি করা বা ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির করা হচ্ছে। আমাদের দেশের কিছু মানুষ আছে, যারা তেল-পেয়াজের কিছু দাম বাড়লেই আমদানি করতে বলে, এরা জানে না, এই আমদানির ডলার দিয়েই তার ভাইয়ের বুকে গুলি চালানো হচ্ছে।

 অর্থাৎ আপনি দেশের বাইরের কিছু ব্যবহার করা মানেই ডলার ব্যবহার করা। এজন্য আমাদানি বিষয়টিই আসলে খারাপ। যে কোন প্রকার আমদানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত। বাংলাদেশে অনেক কিছুই এখন তৈরী হয়, এবং আরো অনেক কিছু করা সম্ভব, কিন্তু তারপরও শুধুমাত্র আমেরিকান সম্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য, ডলারের মূল্যমান ধরে রাখার জন্য নানান কায়দায় আমাদেরকে আমদানি নির্ভর করে রাখা হয়। এক্ষেত্রে, আমরা যদি দেশী পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হতাম, দেশের মাটির নিচের সম্পদ ব্যবহার করতাম, পশ্চিমা বা বিদেশী চাকচিক্যময় পণ্য দেখে বিদেশী পণ্যের উপর ঝাপিয়ে পড়তাম না, তবে অবশ্যই ডলারের ব্যবহার হ্রাস করা সম্ভব ছিলো। এছাড়া যদি দেশে প্রচুর শিল্প কারখানা তৈরী করা যেতো, যেখানে দেশের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব হতো, তবে ডলারের ব্যবহার হ্রাস করা সম্ভব হতো।

 মনে রাখবেন, বর্তমানে মার্কিন সম্রাজ্যবাদের অন্যতম শক্তি হচ্ছে ডলার। ডলারের পতন হলে আমেরিকান সম্রাজ্যবাদের পতন অবশ্যম্ভাবী। তাই আমরা যদি আমদানি হ্রাস করে ডলারের ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারতাম, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি এমনিতেই কমে আসতো, এবং তার সম্রাজ্যবাদের পতন ঘটতো, সে যত্রতত্র দ্বীন ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী কর্মকাণ্ডে সহায়তা করতে পারতো না।

 তাই বর্তমানে আমেরিকাকে দুর্বল করতে ডলারের ব্যবহার হ্রাস করতে, বিদেশী পণ্য বর্জন করে দেশী পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়া খুব জরুরী।

Comments