১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রয়োজনীয় ইতিহাস-
ভারত কেন বাংলাদেশকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিলো? -এস হাবীব
আজকাল ভারতীয়রা প্রায়শঃ একটা কথা বলে, “ভারত বাংলাদেশকে ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিলো, সুতরাং বাংলাদেশীদের উচিত ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।”
এ কথার পাল্টা একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয়, ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিলো বুঝলাম, কিন্তু কেন সাহায্য করেছিলো? এর পেছনে কি ভারতের কোন স্বার্থ ছিলো? নাকি নিঃস্বার্থ সাহায্য ছিলো?
এজন্য আসলে প্রথমেই জানা দরকার ১৯৭১ সালে কেন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো?
পাকিস্তানের দুটি অংশ ছিলো, একটি পশ্চিম পাকিস্তান, অন্যটি পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানে কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস- পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচি ও পাঠান। আর পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি। পাঞ্জাবি জাতিগোষ্ঠীর সেনাবাহিনীতে আধিক্য ছিলো। এ আধিক্যকে কাজে লাগিয়ে পাঞ্জাবিরা অধিক সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা ভোগ করতো এবং অন্য জাতিগোষ্ঠী অর্থাৎ সিন্ধি, বেলুচি, পাঠান ও বাঙালিদের অল্পতে সন্তুষ্ট থাকতে বলতো, বৈষম্য করতো। তবে অন্যসব জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় বাঙালিদের জনসংখ্যা ছিলো বেশি। অন্যরা পাঞ্জাবিদের এ বঞ্চনার বিরুদ্ধে তেমন প্রতিরোধ-বিদ্রোহ গড়তে না পারলেও একমাত্র বাঙালিরাই সফলতার সাথে পাঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে এবং সেই বিদ্রোহের কারণেই সূচনা হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের, জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের।
এবার আমরা জানবো, ভারত বাংলাদেশকে যতটুকুই সাহায্য করেছিলো, তার পেছনে কি তার কোন স্বার্থ ছিলো, নাকি নিঃস্বার্থ ছিলো-
১. ভারত-পাকিস্তান দুই চিরশত্রু। একজন অপরজনের ক্ষতি করতে চায়। পূর্ব ভারতের ৭টি রাজ্য (অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা) তাদের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এবং বাংলাদেশ দিয়ে ঘিরে আছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ থাকা অবস্থায় প্রায়ই পাকিস্তান এই ৭টি অঙ্গরাজ্যে বিদ্রোহ উস্কে দিতো, ফলে সমূহ সম্ভবনা তৈরী হয় ঐ রাজ্যগুলো ভারত থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়ার। এ পরিস্থিতিতে নিজের অখণ্ডতা রক্ষার্থে ভারতের জরুরী হয়ে যায় বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার। বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানের কাছে মারাত্মক নাকানি-চু্বানি খায়। সে শিক্ষা থেকে তারা নিশ্চিত হয়, কখন যদি তাদের পূর্বাঞ্চলের ৭ অঙ্গরাজ্য নিয়ে যুদ্ধ হয়, এবং বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানের অংশ থাকে, তবে সেই রাজ্যগুলোকে তারা কখনই রক্ষা করতে পারবে না। তাই নিজেদের অখন্ডতার স্বার্থেই ভারত বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সাহায্য করে। তাই বলতে হয়, ৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে উপকার করেনি, বরং নিজেরাই নিজেদের উপকার করেছে।
২. কোন কোন ঐতিহাসিক একাত্তরের ইতিহাস লিখতে গিয়ে বলেছেন, ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের সাথে ভারতের ৭ দফা মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন হয়েছিলো। ইতিহাসের পাতায় তারা আরো দাবী করেন, এই চুক্তিতে এমন কিছু শর্ত ছিলো, যার কারণে সেখানে স্বাক্ষর করতে গিয়ে প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অজ্ঞান হয়ে যান। এই চুক্তির শর্ত হিসেবে, ভারত বাংলাদেশকে যুদ্ধে সাহায্যের বিনিময়ে কিছু কিছু কঠিন বিষয় দাবী করে, যেমন- ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশে ইচ্ছামত অবস্থান করবে, বাংলাদেশের নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকবে না, বাংলাদেশের প্রশাসনের একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ নিবে ভারতীয় কর্মকর্তারা, দুই দেশের মধ্যে উন্মুক্ত বাণিজ্য হবে ইত্যাদি। (তথ্যসূত্র: ২৬৬ দিনে স্বাধীনতা,নুরুল কাদির, ভ্রাম্যমান রাষ্ট্রদূত, মুজিবনগর সরকার; সিদ্দিক সালিকের নিয়াজির আত্বসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৫৬)
ঐতিহাসিকদের এ ধরনের তথ্য যদি সত্য হয়, তবে একাত্তরে বাংলাদেশকে ভারত যতটুকুই সাহায্য করেছিলো, তার উদ্দেশ্য কখনই নিঃস্বার্থ ছিলো না। অর্থ্যাৎ সদ্য জন্ম নেয়া দুর্বল বাংলাদেশের সামরিক-বেসামরিক ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ থাকবে তাদের হাতে এই উদ্দেশ্যে তারা বাংলাদেশকে সাহায্য করে।
কিন্তু তাদের এ আশায় গুড়ে বালি হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হওয়ার পর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় অস্থায়ী সরকার যেই চুক্তি করুক, বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে ফিরে এসে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে প্রথম সাক্ষাতে প্রথম যে কথাটা বলেছিলেন, সেটা ছিলো- ‘ভারতীয় সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে কবে প্রত্যাহার করবেন?’ ইন্দিরা গান্ধী সৈন্য রাখার পক্ষে কিছু যুক্তি তুলে ধরতে গেলেও বঙ্গবন্ধু তাতে ছাড় দেননি, প্রত্যাহারের তারিখ চেয়ে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তায় ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ১৭ই মার্চ ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। ফলে ৭ দফা কথিত মৈত্রি চুক্তির কার্যকরীতা অনেকটাই শেষ হয়ে যায়।
এখানে লক্ষণীয়, ‘৭ দফা মৈত্রী চূক্তি’ বলে যদি সত্যি কিছু হয়ে থাকে, তবে এর দ্বারা প্রমাণ হয়, ভারত বাংলাদেশকে যতটুকুই সাহায্য করুক, এর পেছনে তার হীন লোভ কাজ করেছিলো, যেখানে ছিলো সামরিক-বেসামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে নতুন ও দুর্বল রাষ্ট্রটিকে গ্রাস করে নেয়ার উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তাদের সাহায্যটুকু মোটেও নিঃস্বার্থ ছিলো না।
এখানে একটি ইতিহাস জেনে রাখা দরকার, ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ বলতে আমরা যে যুদ্ধকে বুঝি, ভারতীয়রা কিন্তু সেই যুদ্ধ বুঝে না। আমরা যে যুদ্ধ বুঝি, তার সূচনা হয়েছিলো ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। অপরদিকে ভারতীয়রা ১৯৭১ সালের ইন্দো-পাকিস্তানী যুদ্ধ বলতে যে যুদ্ধ বুঝে তার সূচনা হয় ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। দুই দেশই ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখকে বিজয় দিবস দাবী করে। অর্থাৎ আমাদের যুদ্ধ হয়েছিলো ৯ মাস, অপরদিকে ভারতের যুদ্ধ হয় মাত্র ১৩ দিন। এখানে পার্থক্যটা কোথায়?
এর পার্থক্যটা হচ্ছে, ভারতের পশ্চিমে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে দুই দেশের বিমানবাহিনীর মধ্যে একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরী হয়। যাকে বলা হয় ১৯৭১ সালের ইন্দো-পাকিস্তানী যুদ্ধ। কিন্তু সেই যুদ্ধে ভারতীয়রা তেমন সাফল্য না দেখাতে পারলেও বাংলাদেশীরা ৯ মাস যুদ্ধ করে পাকিস্তানীকে প্রায় ধরাশায়ী করে ফেলে। যুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে, অর্থাৎ বিজয়ের মাত্র ১১ দিন পূর্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী ৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বাংলাদেশীদের সাথে মিলে মিত্রবাহিনী গঠন করে। মাত্র ১১ দিন পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই সম্মিলিত বাহিনীর কাছে পাকিস্তানী বাহিনী আনুষ্ঠানিক আত্মসমপর্ণ করে।
প্রশ্ন এসে যায়, যুদ্ধের মাত্র ১১ দিন আগে যদি ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে না আসতো, তবে কি বাংলাদেশীরা পাকিস্তানীদের পরাজিত করতে পারতো না?
অবশ্যই পারতো। কারণ ভারতীয়রা বাংলাদেশে আসার বহু আগেই পাকিস্তানীরা বাংলাদেশীদের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে পরাজিত হয়েছিলো এবং বাংলাদেশের অনেক এলাকা ততদিনে স্বাধীন হয়ে গিয়েছিলো। তবে বিজয়ের মাত্র ১১ দিন আগে এসে ভারতীয়রা শুধু শেষ আনুষ্ঠানিকতা সেরেছে মাত্র। বিষয়টা অনেকটা সূচ রাজার গল্পের মত। আসল রানী ঘুমন্ত সূচ রাজার দেহের সব সূচ তুলেছে, চাকরানী এসে শুধু চোখের সুই দুটো তুলে নিজে সব কৃতিত্ব দাবী করে বসে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য ছিলো সূচ রাজার গল্পের চাকরানীর মত, এর বেশি কিছু না।