রাষ্ট্র পদ্ধতিতে কালো টাকা এবং দ্বীন ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম টাকা
আমরা অনেক সময় কালো টাকা বা ব্ল্যাক মানি বলে একটা শব্দ শুনি। অনেকে এই ব্ল্যাক মানিকে হারাম বা অবৈধ টাকা বলেও মনে করে। আসলে রাষ্ট্র পদ্ধতিতে কালো টাকা আর দ্বীন ইসলামে হারাম টাকা এক জিনিস নয়। পবিত্র দ্বীন ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম বা অবৈধ টাকা বলা হয় সেই টাকাকে যে, যে টাকা হারাম (শরীয়তে নিষিদ্ধ) কোন উপায়ে উপার্জন করা হয়। অপরদিকে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কালো টাকা বলা হয় সেই টাকাকে, যেই টাকার ইনকাম ট্যাক্স (আয়কর) পরিশোধ করা হয় না।
মূলতঃ পবিত্র দ্বীন ইসলামে উপার্জিত অর্থ পরিশুদ্ধ করার জন্য যাকাত দিতে হয়, ট্যাক্স দিতে হয় না। এক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি ইনকাম করে খরচ করার পর অবশিষ্ট নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পরিমাণ নির্দ্দিষ্ট সময়ব্যাপী জমা থাকলে তার যাকাত দিতে হয়। এর পরিমাণ শতকরা ২.৫%। অপরদিকে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোন ব্যক্তি একটি নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ইনকাম করলেই সেই ইনকামের একটা অংশ ট্যাক্স হিসেবে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। এর পরিমাণ সর্বনিম্ন ৫% থেকে শুরু করে ৩০% শতাংশ পর্যন্ত হয়। কেউ সেই ট্যাক্স না দিলেই মূল টাকাকে কালো টাকা বা ব্ল্যাক মানি বা অপ্রদর্শিত অর্থ বলে।
আসলে কষ্ট করে ইনকামের টাকার এত উচ্চহারে ট্যাক্স অনেকেই ইচ্ছুক থাকেন না। বিশেষ করে যারা বেশি ইনকাম করেন, তাদের ৩০% এর উপর কেটে নেয়া হয়, ফলে কেউ কেউ সেই টাকা রাষ্ট্রকে প্রদর্শন করতে চায় না। আমরা মাঝে মাঝে সংবাদে দেখি, অনেকে বিদেশে টাকা পাচার করে। পাচারকৃত এ অর্থের মধ্যে কালো টাকা রয়েছে।
আবার যেহেতু বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ ট্যাক্স কেটে রাখা হয়, এজন্য অনেক ব্যবসায়ী সাদা টাকা দেশে ইনভেস্ট করতে চায় না, বিদেশে ইনভেস্ট করে। সরকার যদি এত বিপুল পরিমাণে টাক্স কেটে না রাখতো, তবে অনেক ব্যবসায়ী টাকা বিদেশে না পাঠিয়ে হয়ত দেশেই রাখতো বা দেশে ইনভেস্ট করতো, যা দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতো।
মূলতঃ বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকাগুলো বিদেশের বিভিন্ন ‘ট্যাক্স হেভেন’ এ চলে যায়। ট্যাক্স হেভেন হচ্ছে, সেই সব রাষ্ট্র, যেখানে ইনকাম ট্যাক্স নেই অথবা খুবই সামান্য।
লক্ষ্য করলে দেখবেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন বিদেশী ফান্ডপ্রাপ্ত এনজিওগুলো কালো টাকার বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার। তার সাথে কিছু সুশীল দৈনিক পত্রিকাও ‘বদলে যাও, বদলে দাও’ শ্লোগান দিয়ে কালো টাকার বিপক্ষে কথা বলে। ‘কালো টাকা মানেই দুর্নীতি’, ‘কালো টাকাকে কোনভাবেই সুযোগ দেয়া যাবে না’ ইত্যাদি নিয়ে বেশ জোরালো শ্লোগান তুলে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশী ফান্ডিং এ পরিচালিত এসমস্ত এনজিওগুলো কার স্বার্থে কথিত ‘কালো টাকা’ নিয়ে এত সোচ্চার ? বিদেশীদের এখানে স্বার্থ কি ? কেন তারা টাকা খরচ করে বাংলাদেশে এ সমস্ত এনজিও পরিচালনা করছে ?
আসলে বাংলাদেশে কালো টাকার বিরুদ্ধে শ্লোগান যত উঠবে, কালো টাকার মালিকারা বাংলাদেশে সেই টাকা রাখতে তত বেশি ভয় পাবে। বিদেশে পাচার করে দিবে এবং ট্যাক্স হেভেনে বিদেশী ব্যাংকগুলো সেই টাকা পেয়ে যাবে। প্রশ্ন থেকে যায়, সেই সব ট্যাক্স হেভেনের ব্যাংকগুলোই টাকা খরচ করে এসমস্ত এনজিও বা পত্রিকাগুলোকে ভাড়া করেনি তো ? কারণ এ সমস্ত এনজিও ও পত্রিকাগুলোর পারফর্মেন্সের উপর নির্ভর করছে ট্যাক্স হেভেনের ব্যাংগুলোর অর্থ প্রাপ্তি।
২০১৯ সালে জাতিসংঘে এক ভাষণে ইমরান খান এসব ট্যাক্স হেভেনের বিরুদ্ধে বলেছিলো-
“প্রত্যেক বছর বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা দরিদ্র দেশগুলো থেকে ধনী দেশগুলোতে প্রাচার হয়ে যাচ্ছে। মুদ্রা পাচার, কর ফাঁকি, পশ্চিমা দেশে বিলাসবহুল সম্পত্তি ক্রয়ের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা এটা করছে। উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য এটা ধ্বংসাত্মক। এর ফলে ক্রমশ ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর পার্থক্য আরো বাড়ছে। মাদক এবং সন্ত্রাসে অর্থায়নের মতো অর্থ পাচারকে একইভাবে ট্রিট করা হচ্ছে না। বর্তমানে দরিদ্র দেশগুলোর সম্পদ তাদের এলিটরা লুট করে নিচ্ছে। আমরা দেখতে পাই, দুর্নীতিবাজ নেতাদের পাচারকৃত অর্থ পশ্চিমা পুঁজিতে বিনিয়োগকৃত। এটা উদ্ধার করা আমাদের জন্য অনেক কঠিন। কিন্তু আইন এসব অপরাধীদের রক্ষা করছে। ধনী দেশগুলোর অবশ্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। দরিদ্র দেশগুলো হতে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থের পাচার তারা অনুমোদন দিতে পারে না। ক্ষমতাশীল এলিটদের বিদেশী ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ প্রাচার করতে সুযোগ দেয়া উচিত নয়। আমি বুঝতে পারি না, কেন ট্যাক্স হেভেন অনুমোদিত। কেন এই ট্যাক্স হেভেন? কেন এটা অনুমোদিত? কেন গোপন হিসাব? বিশ্বে পরিবর্তন হচ্ছে। গরীব আরো গরীব হচ্ছে এবং ধনী হচ্ছে আরো ধনী। এটা বড় একটি সংকট তৈরি করবে। ” (সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)
উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৯টি অঙ্গরাজ্যকে বলা হয় ট্যাক্স হেভেন, যেখানে ইনকাম ট্যাক্স নেই। আবার কানাডা, সুইজারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, পানামা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরসহ এমন কিছু রাষ্ট্র আছে, যারা ট্যাক্স হেভেন বলে পরিচিত। এসব স্থানেই দেশের টাকা পাচার হয়ে যায়।
মূল কথা হলো, দেশে ইনকাম ট্যাক্স যত বাড়বে, দেশের সম্পদ তত বিদেশে পাচার হবে। ফলে আমাদের দেশের টাকা নিয়ে পশ্চিমারা আরো ধনী হবে। এজন্য আমি ‘ব্ল্যাক মানি’ থিউরীকে সমর্থন করতে পারি না। কারণ পশ্চিমারা এসব ‘ব্ল্যাক মানি’ থিউরী বানায়ছে, যেন আমাদের দেশের টাকা তাদের দেশে জমা রাখা হয়, আর সেই টাকা দিয়ে তারা বড়লোক হয়। এজন্য আমি এ থিউরীর বিপক্ষে।