দ্বীনি স্টারকিড কি?

দ্বীনি স্টারকিড কি?

 

দ্বীনি স্টারকিড কি?

-এস হাবীব

 কয়েকদিন আগে ভারতের মুম্বাইয়ের ধীরুভাই আম্বানি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের বার্ষিক দিবসে স্কুলের স্টেজ পারফরম্যান্সে অংশ নেয় হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সন্তানরা। তাদেরকে বলা হচ্ছিলো ‘স্টারকিড’। তাদের পারফরম্যান্স নিয়ে অনলাইন জগতে হচ্ছিলো তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। যদিও অভিনয়-নাচ-গান সবগুলো বিষয় হারাম ও না-জায়িজ, তারপরও ‘স্টারকিড’ ধারণা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।

 একজন সফল বাবা-মা চায় তার সন্তান তার পেশায় বা মতাদর্শে আসুক। ‘বাপকা বেটা, সিপাইকা ঘোড়া কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া’। অর্থাৎ সন্তানের যাইহোক না কেন, পিতার গুণ কিছুটা হলেও সন্তানের উপর এমনিতেই বর্তাবে। এজন্য বাবা-মা যে আদর্শ বা চিন্তাধারা লালন করে কিংবা যে পেশা পালন করে, সেই চিন্তাধারা, আদর্শ ও পেশা সন্তানদের জন্য ধারণ করা অনেক সহজ হয়, যা অন্যের সন্তানদের জন্য অনেক অপেক্ষাকৃত কঠিন ও সময় সাপেক্ষ বিষয়।

 আমরা যারা চিন্তা করি, পবিত্র দ্বীন ইসলামের খিদমতে কিছু করবো কিংবা মুসলিম উম্মাহের কঠিন সময় উত্তরণে কাজ করবো, তাদের জন্য এ ‘স্টারকিড’ ধারণাটি অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরী। কারণ কাফিররা যখন কাজ করে, তখন দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম শত-হাজার বছরের প্ল্যান করে কাজ করে তাদের ধর্মীয় লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়। পিতা নিজে কাজ করে এবং মৃত্যুর আগে সন্তানকে বলে দেয়, বাবা আমি এতটুকু কাজ করলাম, বাকিটা তুমি এগিয়ে নিয়ো। সেই সন্তান নিজে কাজ করে অতঃপর মৃত্যুর আগে তার সন্তানকে বলে যায় বাকিটা কাজ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিতে। সেই সন্তানও কাজ করে এবং তার সন্তানকে বলে যায়, বাকিটা কাজ এগিয়ে নিতে। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের কাজ চলতে থাকে।

 এই যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কাজ, আপনি যখন পবিত্র দ্বীন ইসলাম কিংবা মুসলিম উম্মাহের স্বার্থে কাজ করবেন, তখন তা খুব ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে। কারণ এ কাজগুলো সংক্ষিপ্ত সময়ের কোন কাজ না, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে কাজ। তাই আপনি নিজে কাজ করছেন, কিন্তু আপনার সন্তান সেই রাস্তায় আসবে কি আসবে না, সেটা নিয়ে অবশ্যই আপনাকে চিন্তা করতে হবে।

 বাচ্চাকে যদি আপনি ‘দ্বীনি স্টারকিড’ বানাতে চান, তবে প্রথমে বাবা-মাকে দ্বীনের লাইনে স্টার হতে হবে, অথবা অন্তত এতটুকু বিশ্বাস করতে হবে, সে যে রাস্তায় আছে বা কাজ করছে সেটা সঠিক। কিন্তু বাবা-মা প্রকৃত বিশ্বাসী না হলে, আসলে বাচ্চাকে বানানো কঠিন।

 আমি এমন অনেক পিতা-মাতাকে চিনি, যারা নিজেরা দৃশ্যত্ব দ্বীন ইসলামের জন্য কাজ করেন, কিন্তু সন্তানকে সে কাজে দিতে আগ্রহী না। হতে পারে, দ্বীন ইসলাম বা মুসলমানদের পক্ষে কাজ করতে গেলে তার ভবিষ্যত রুটি-রুজি বা সোশ্যাল স্টাটাসের কি হবে, এ বিষয়টি নিয়ে বাবা-মা অনেক সময় কনফিউজড হয়ে পরেন। যদিও যারা সঠিক উপায়ে দ্বীন ইসলামের জন্য কাজ করে তাদের রুটি-রুজি বা সোশ্যাল স্ট্যাটাসের অভাব হয় না, বরং অনেকের থেকে অনেক বেশি হওয়ার উদাহরণ আছে। এজন্য বাবা-মায়ের চেতনা উন্নয়নে আগে কাউন্সিলিং দরকার। যারা এ বিষয়গুলো ভালো বুঝেন, সন্তানের বাবা-মা তার সাথে কথা বলতে পারেন অথবা সন্তানকে কথা বলতে পাঠাতে পারেন।

 আসলে বাবা-মায়ের চেতনা যদি দৃঢ় থাকে তবে ভিন্ন চিন্তা করার সুযোগ থাকে না। মূলতঃ মানুষের ইনভেস্টমেন্টের চূড়ান্ত নির্দশন হচ্ছে সন্তানকে ইনভেস্ট করা। একজন বাবা-মা যখন তার সন্তানকে কোথাও বিনিয়োগ করে, বুঝতে হবে সেখানে প্রকৃতপক্ষেই তার বিশ্বাস আছে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বুঝতে সহজ হবে। যেমন- হযরত ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার প্রিয় সন্তান হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে কুরবানী করার জন্য নিয়ে যান, কারণ আল্লাহ পাক উনার প্রতি হযরত ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস আছে, যেখানে কোন সন্দেহ নাই।

 আবার বিপরীত যদি চিন্তা করি, আজকে যারা শিক্ষা কারিকুলাম তৈরী করছে, তারা অন্যের সন্তানকে বাংলা মিডিয়ামে পড়তে বললেও নিজের সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছে। কারণ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর তাদের নিজেদের আস্থা ও বিশ্বাস নেই।

 আবার ধরুন, ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের পেছনে যারা কাজ করছে, যারা অন্যের বাচ্চাকে মোবাইল-কম্পিউটার-ট্যাবে অভ্যস্ত হতে বলছে, সেই মাইক্রোসফটের বিলগেটস, অ্যামাজনের জেফ বেজোস, ফেসবুকের জুকারবার্গ কিংবা টুইটারের ইলন মাস্করা কিন্তু নিজেদের ছেলে মেয়েদের সেখানে অভ্যস্ত করাচ্ছে না, বরং তাদের বাচ্চারা যেন ডিভাইস থেকে দূরে থাকে সেই চেষ্টা করছে। অর্থাৎ আপনি দৃশ্যত্ব যে মতাদর্শ বা চিন্তাধারার উপর চলছেন, সেখানে আপনার পূর্ব বিশ্বাস ও আস্থা আছে কি নেই, সেটা তখনই বুঝা যাবে, যখন আপনি নিজের সন্তানকে সেখানে ইনভেস্ট করতে চাইছেন কি, চাইছেন না, তার উপর।

 এখানে বুঝার বিষয় হচ্ছে, বর্তমান মুসলমানদের কঠিন পরিস্থিতি উত্তরণে এবং পুনরায় মুসলমানদের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে এক প্রজন্ম দিয়ে কাজ হবে না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাজ করতে হবে। আপনি যদি নিজেকে ফার্স্ট জেনারেশন মনে করেন, তবে আপনার উপর নির্ভর করে আপনার সন্তান মানে সেকেন্ড জেনারেশন কাজ করবে, তার উপর নির্ভর করে তার সন্তান মানে থার্ড জেনারেশন কাজ করবে। এভাবে করে চলতে থাকবে। কিন্তু আপনি নিজেই যদি আপনার বিশ্বাস বা আদর্শ আপনার সন্তনের উপর প্রবাহিত করতে ব্যর্থ হোন, তবে সেখানে জেনারেশন গ্যাপ তৈরী হয় এবং সেক্ষেত্রে আপনার উপর বর্তমান দ্বীনি ইনভেস্টমেন্টকে আপনি নিজেই অপচয় বানিয়ে দিবেন।

 আবার, আমি দেখেছি, অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের দ্বীনের রাস্তায় আনতে চায় আনুষ্ঠানিক (ফর্মাল) উপায়ে।

অনেকে এক্ষেত্রে ব্যর্থও হোন। আসলে সব ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক (ফর্মাল) উপায়ে কাজ হয় না, অনেক ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক (ইনফর্মাল) ভাবেও কাজ হয়। কারণ ফর্মাল পদ্ধতির চেয়ে ইনফরমাল পদ্ধতিতে বিলিফ (বিশ্বাস বা আকিদা) অনেক বেশি আদান-প্রদান হয়। দেখা যায়, আপনার সন্তান ফর্মাল পদ্ধতিতে দ্বীনি কাজে সম্পৃক্ত হলেও ইনফরমাল পদ্ধতিতে অনেক দ্বীন-বহির্ভূত কাজ বা লোকের সাথে সে সম্পৃক্ত, সেখান থেকেই শিক্ষা নিয়ে সে ভিন্ন রাস্তায় চলে যায়। একটি উদাহরণ দিলে বুঝতে সহজ হবে, একজন বাবা-মা বাচ্চাকে মসজিদ-মাদ্রাসায় পাঠিয়ে ভাবছেন, এতেই হবে। কিন্তু সেখানে বাচ্চাটি আনুষ্ঠানিক (ফর্মাল) উপায়ে শিখছে। কিন্তু বাসায় বা এলাকায় এসে, বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজনের সাথে অনানুষ্ঠানিক (ইনফর্মাল) উপায়ে অনেক কিছু শিখছে। দেখা যায়, অনেক সময় অনানুষ্ঠানিক (ইনফর্মাল) উপায়ে প্রাপ্ত জ্ঞান প্রাধান্য পেয়ে সন্তানটি দ্বীনি কাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়।

 এজন্য আপনি যদিও সত্যিই চান, পবিত্র দ্বীন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহের স্বার্থে কাজ হোক, মুসলমানদের স্বর্ণযুগ পুনরায় ফিরে আসুক, তবে শুধু নিজে কাজ করলে হবে না, বরং আপনার পরবর্তী প্রজন্মকেও সেখানে সম্পৃক্ত করতে হবে। সন্তানকে শুধু মৌখিক তাত্ত্বিক জ্ঞান (নলেজ) দিলে হবে না, তাকে হাতে ধরে কাজ করে ব্যবহারিক কাজ শিখিয়ে দিতে হবে, দক্ষতা (স্কিল) শেখাতে হবে। তাকে মুসলমানদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞান দিতে হবে, দ্বীনি অভিভাবক চিনিয়ে দিতে হবে, শত্রু সম্পর্কেও জ্ঞান দিতে হবে। ফর্মাল (আনুষ্ঠানিক) ভাবে শেখাতে হবে, ইনফরমাল (অনানুষ্ঠানিক) ভাবেও শেখাতে হবে।

 মনে রাখবেন, মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত, তাই আপনার সফলতার ৯০% নির্ভর করছে আপনি পরবর্তী প্রজন্মকে আপনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন কি না, তার উপর। এ সংগ্রাম তো আর একদিনের না, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সুতরাং পবিত্র দ্বীন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ’র স্বার্থে আপনার সন্তানকেও ‘দ্বীনি স্টারকিড’ বানাতে হবে, এটা অবশ্যই আপনার লক্ষ্য হওয়া উচিত।

Comments