এক ইহুদীর কুবুদ্ধিতে বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ শুরু

Comments · 962 Views

এক ইহুদীর কুবুদ্ধিতে বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ শুরু

  এক ইহুদীর কুবুদ্ধিতে বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ শুরু

 অতি সম্প্রতি ২৯ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে মার্কিন নীতি নির্ধারক হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছে। একজন বাংলাদেশী হিসেবে তার নামটা শুনলে যে কথাটা সর্বপ্রথম মনে পরে সেটা হলো, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশকে সে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলো। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশকে কেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলো কিসিঞ্জার ? কি ছিলো তার উদ্দেশ্য?

 এ উত্তর দেয়ার আগে প্রথমেই হেনরি কিসিঞ্জারের পরিচয় সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক। হেনরি কিসিঞ্জার হচ্ছে একজন জার্মান ইহুদী। নাৎসীদের নির্যাতনে আমেরিকায় পালিয়ে আসা হেনরি কিসিঞ্জার এক সময় বনে যায় আমেরিকার নীতি নির্ধারক। বর্তমান মার্কিন সম্রাজ্যবাদ বিস্তারের পেছনে কিসিঞ্জারের রয়েছে বিপুল অবদান। ইস্ট ব্লক থেকে চীনকে ভাগিয়ে আমেরিকার সাথে মৈত্রি স্থাপনের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে একা করার অন্যতম কারিগর ছিলো সে। বেশ কয়েকজন আমেরিকান রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে এই ইহুদী।

 মূলতঃ ১৯৭৪ সালে হেনরি কিসিঞ্জার একটি পলিসি প্রণয়ন করে, যার উদ্দেশ্য ছিলো মার্কিন সম্রাজ্যবাদকে শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী করা। সেই পলিসির নাম - National Security Study Memorandum 200 বা NSSM200 । এই পলিসিকে ’৭৪ এর কিসিঞ্জার রিপোর্ট নামেও ডাকা হয়। এই পলিসির মূল কথা হচ্ছে, মার্কিন অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ রক্ষার জন্য বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা বেড়ে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হতে পারে। তাই এ পলিসি অনুসারে মার্কিন স্বার্থে ১৩টি রাষ্ট্রের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো বাংলাদেশ। মূলতঃ এই পলিসি বাস্তবায়ন করতেই সে বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশকে জনসংখ্যার ভয় দেখায় এবং ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে জননিয়ন্ত্রণ করতে বলে।

 ইহুদীদের একটি স্বভাব সবসময় মনে রাখবেন, সে নিজের প্রয়োজনটা অপরের প্রয়োজন হিসেবে দেখায়। তাদের প্রয়োজন আমেরিকার সম্র্যাজ্যবাদের বিস্তার ও সুসংহত করা। এজন্য তারা চাইছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হ্রাস করতে। কিন্তু সেটা সে নিজ প্রয়োজন না বরং বাংলাদেশের প্রয়োজন হিসেবেই দেখাচ্ছে। বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশকে অভাব থেকে বাচতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার কুবুদ্ধি দিচ্ছে। মূলতঃ তার বুদ্ধিতেই পরবর্তীতে বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম গৃহিত হয়।

 বর্তমানেও লক্ষ্য করবেন, বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন এনজিও কাজ করে, যাদের অর্থদাতা বিভিন্ন বিদেশী রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবে একটা প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা হ্রাসে বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর এত ঠেকা কেন? নিজের গাটের টাকা খরচ করে আমাদের উপকার করতে আসছে। আবার লক্ষ্য করবেন, একদিকে তারা বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে টাকা দিচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের যুবক শ্রেনীকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার লোভ দেখিয়ে তাদের দেশে নিয়ে তাদের জনসংখ্যা ঠিক রাখছে। তারমানে বুঝা যাচ্ছে, জনসংখ্যা কোন বোঝা নয়, বরং সম্পদ। তারা বাংলাদেশের সম্পদ নষ্ট করে, বাকিটা তাদের দেশে পাচার করে নিয়ে যায়।

 যাই হোক, বাংলাদেশকে ছাড়াও সে সময় একই কুবুদ্ধি হেনরি কিসিঞ্জার চীনকেও দিয়েছিলো। কিসিঞ্জারের বুদ্ধিতে চীন ১৯৭৯ সালে ‘এক সন্তান নীতি’ নামক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে একটি আইন প্রণয়ন করে। এ আইন অনুসারে চীনে কারো একটির বেশি সন্তান থাকতে পারতো না। একাধিক সন্তান হলে, বাবা-মাকে জরিমানার মুখে পড়তে হতো, চাকরি হারাতে হতো, এমনকি জোরপূর্বক গর্ভপাতও করতে হতো। দাবী করা হয়, এভাবে প্রায় ৪০ কোটি শিশুকে গর্ভে হত্যা করে চীন সরকার।

 চীনের এক সন্তান নীতি সম্পর্কে মিডিয়ায় বিভিন্ন সময় খবর প্রকাশ পায়। যেমন- “২০১২ সালে এক চীনা নারী দ্বিতীয়বারের মতো সন্তানসম্ভাবা হয়েছিলো। ওই সময় এক সন্তান আইন লঙ্ঘন করায় তাকে ও তাঁর স্বামীকে জরিমানা করে কর্তৃপক্ষ। জরিমানা না দেওয়ায় সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারীকে জোরপূর্বক গর্ভপাত করানো হয়। ..................আরেক চীনা ব্যক্তি বলে, আইন ভঙ্গ করে তাঁর জন্ম হওয়ায় ‘অবৈধ শিশু’ হিসেবে সে বড় হয়ে উঠেছিলো। তা–ও গ্রামাঞ্চলে লুকিয়ে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তারা যখনই বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোনো বাড়িতে কতজন আছে সেই খোঁজ নিতো, তখনই সে পুকুরে ডুব দিয়ে লুকিয়ে থাকতো। কারণ, আইন ভঙ্গের কারণে জরিমানা দিতে হতো। সেটা পরিশোধ না করলে ঘর খালি করে জিনিসপত্র বা পোষাপ্রাণী নিয়ে যাওয়া হতো। (দৈনিক প্রথম আলো, চীনের এক সন্তান নীতির বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা, ১লা জুন, ২০২১)

 

   কিসিঞ্জারের বুদ্ধিতে ‘এক সন্তান নীতি’ গ্রহণ করে চীনের ক্ষতি হয়েছে, এটা বুঝতে চীনের ৩৭ বছর সময় লাগে। ২০১৬ সালে তাই দেশটি ‘এক সন্তান নীতি’ থেকে সরে আসে। জন্ম নিয়ন্ত্রণের এ পলিসির কারণে চীনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূন্যের কাছাকাছি পৌছে। জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্য যে পরিমাণ জন্মহার থাকা প্রয়োজন, দেশটির বর্তমান জন্মহার তার চেয়েও কম। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এ নীতির কারণে দেশটিতে কমে গেছে যুবকদের সংখ্যা, অন্যদিকে বেড়েছে বয়সী মানুষের সংখ্যা। কর্মঠ মানুষ কমে পেনশন ভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ এই সমস্যা আরো প্রকট, কারণ দেশের কর্মক্ষম মানুষের একটা বড় অংশ অবসরে চলে যাবে, কিন্তু সে অনুপাতে তরুণ প্রজন্ম আসবে না। এতে ভেঙ্গে পড়বে দেশটির অর্থনীতি।

      বর্তমানে জনসংখ্যার হার বৃদ্ধির জন্য চীন বেশ উদ্যোগ নিয়েছে। অধিক সন্তনের জন্য পিতা-মাতার জন্য পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। বর্তমানে সন্তানের মা-বাবা হলে চীনে বেতনসহ ছুটি, কর ছাড় ও আর্থিক পুরস্কার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শিশুকে লালন-পালনের জন্যও দেয়া হচ্ছে নানা রকম উৎসাহ ভাতা।

 

অর্থাৎ, বাংলাদেশ, চীনসহ বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কুবুদ্ধি দাতা ছিলো ইহুদী হেনরী কিসিঞ্জার। তবে এর পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিলো, ঐ রাষ্ট্রের উন্নতি নয়, বরং আমেরিকার উন্নতি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কুবুদ্ধি যে এক ইহুদীর মাথা থেকে বের হয়েছিলো, এটা হয়ত অনেকেরই জানা নেই।

Comments