বিনোদনের প্রয়োজন সমাজে বাড়ছে কেন?

Comments · 2075 Views

বিনোদনের প্রয়োজন সমাজে বাড়ছে কেন?

 বিনোদনের প্রয়োজন সমাজে বাড়ছে কেন?

-শেখ মুহম্মদ রাফজানযানি

 আমাদের সমাজে বিনোদন শব্দটা বহুল ব্যবহৃত । সমাজবিজ্ঞানীরা দাবী করে, সারা দিন কাজ করে মানসিক প্রশান্তির জন্য বিনোদনের দরকার, মাঝে মাঝে ছুটি নিয়েও বিনোদনের দরকার। এতে নাকি মানসিক সুস্থতা আসে এবং কাজের গতি বাড়ে। ফলে কাজের শেষে সবাই ছুটছে বিনোদনের দিকে। কেউ হালাল ভাবে বিনোদন খুজলেও, অধিকাংশ মানুষ বিনোদনের নামে যাচ্ছে হারাম কাজের দিকে।

 আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজে হঠাৎ করে এত বিনোদনের প্রয়োজন হচ্ছে কেন? আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন কি আমাদের এত বিনোদনের প্রয়োজন ছিলো? কিংবা আমাদের বাবা-দাদাদের আমলে কি এত এত বিনোদন ছিলো, কিংবা তাদের এত বিপুল বিনোদন প্রয়োজন হতো? বিনোদনের অভাবে কি তারা মানসিক অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলো? তাহলে এ যুগে এসে বিনোদনের এত প্রয়োজন কেন লাগছে?

 বিনোদন কাকে বলে?

অভিধান বলছে, বিনোদন হচ্ছে সেই জিনিস যা মানুষকে আনন্দ দেয়। মানুষ কাজের ফাকে বিনোদন চায়। তারমানে একটি বিষয় স্পষ্ট, কাজ মানুষকে আনন্দ দিতে পারছে না বিধায় আনন্দ দেয়ার জন্য নতুন একটি জিনিস আনতে হচ্ছে, যার নাম বিনোদন। দৈনন্দিন কাজই যদি মানুষের মনকে আনন্দ দিতে পারতো, তবে নতুন করে তাকে আনন্দ পাওয়ার জন্য বিনোদন নামক নতুন জিনিসকে আমদানি করতে হতো না।

 কাজে কেন আনন্দ আসছে না?

প্রতিটা মানুষের অবচেতন মনে (Subconscious mind)-এ কিছু অবচেতন লক্ষ্য (subconscious goals) থাকে। মানুষ সেই লক্ষের দিকে প্রতিনিয়ত ধাবিত হয়। কখনো সে সেটা বুঝতে পারে, আবার কখনও বুঝতে পারে না। তবে একজন মানুষ যদি হঠাৎ জানতে পারে সে মারা যাবে, তবে তখন তার প্রথম যে বিষয়টির প্রতি আফসুস হয়, ভাবে, “আহহা ! আমি ঐ কাজটি শেষ করে যেতে পারলাম না”, যে কাজটির জন্য তার আফসুস হয়, ঐটাই আসলে তার অবচেতন মনের ভেতর থাকা লক্ষ্য (subconscious goal), যার দিকে সে প্রতিনিয়ত ধাবিত হয়।

 একজন মানুষের দৈনন্দিন কাজগুলো যখন মনের ভেতরের সেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তখন মানুষের মন প্রকৃত আনন্দিত হয়, যেই আনন্দ বিনোদনের সাথে অন্য কোন আনন্দ বিনোদনের তুলনাই হয় না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অধিকাংশ মানুষ তার দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমে তার অবচেতন মনের লক্ষ্য অর্জনে তেমন সাফল্য আনতে পারে না। বরং প্রতিনিয়ত দূরে সরে যায়। ফলে সে ভেতর ভেতর মানসিক অশান্তিতে ভুগে। তখন সে কৃত্রিম বিনোদন খুজে এবং কৃত্রিম বিনোদনের মাধ্যমে মনের অশান্তি প্রশমন করার চেষ্টা করে। বিষয়টা অনেকটা অপরেশন থিয়েটারে ব্যথায় কাতর রোগীকে প্যাথেডিন দেয়ার মত। প্যাথেডিন কিন্তু সমস্যা সারাতে পারে না। প্যাথেডিন দেয়া হয় রোগীর ব্যথ্যা কিছু সময় ভুলিয়ে রাখার জন্য। প্যাথেডিনের প্রভাব কেটে গেলে আবার ব্যথ্যা শুরু হয়। এজন্য ঠিক কি কারণে ব্যথ্যা হচ্ছে সেটার জন্য পৃথক চিকিৎসা করতে হয়। ঠিক একই রকম বিনোদনগুলো আনন্দ দিয়ে আমাদের মনকে কিছু সময়ের জন্য লক্ষ্য অর্জনের ব্যর্থতাকে ভুলিয়ে রাখে। কিন্তু যতক্ষণ আমরা অবচেতন মনের লক্ষ্য (subconscious goals) অর্জনে কেন অগ্রগতি হচ্ছে না, সেটা খুজে বের করতে না পারবো, সঠিক সমাধানে হাঁটতে না পারবো, ততদিন হাজারো বিনোদন দিয়েও কোন কাজ হবে না।

 আবার পাথেডিনের কথায় ফিরে আসি। রোগী প্যাথেডিনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, ব্যথ্যা ভুলতে প্রতিনিয়ত প্যাথেডিনের ডোজ বাড়াতে হয়। ঠিক তেমনি মানুষের বিনোদনের মাত্রাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আগে বছরে একবার লাগতো, এরপর মাসে একবার, এরপর সপ্তাহে একবার, এখন দৈনিক কয়েক ঘণ্টা লাগে বিনোদনের পেছনে।

 এই জন্য আসলে কৃত্রিম বিনোদনের পেছনে না ছুটে অবচেতন মনের ভেতরে থাকা লক্ষ্য (subconscious goals) অর্জনে কেন আমরা সফল হতে পারছি না, সেখানে কেন ব্যর্থ হচ্ছি সেই সমাধান আগে খোঁজা উচিত। কারণ আমার অসুখের ঔষধ একটি, দেয়া হচ্ছে অন্যটি, ফলে অসুস্থতা কখন ভালো হয় না। আর আমার ভুল চিকিৎসার জোগান দিতে কিছু ব্যবসায়ী বিনোদনের নামে বিরাট ইন্ডাস্ট্রি খুলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আবার কেউ কেউ বিনোদনের নামে হারাম জিনিস (নাচ, গান-বাজনা, খেলাধূলা, সিনেমা, নাটক ইত্যাদি) প্রবেশ করিয়ে মানুষের ঈমান নষ্ট করছে।

 তাই আমাদের আসলে সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত করা উচিত। বিনোদন বৃদ্ধির নামে ভুল চিকিৎসায় ভুল ফল আমাদের সমাজকে নষ্ট করে তুলছে।

Comments