দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে পণ্য আমদানিই কি সমাধান?
লেখা: নাজমুল হাসান রুমি
কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ডিমের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজারে দাম বেঁধে দেয় সরকার। কিন্তু তাতেও লাভ না হলে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিদেশ থেকে ডিম আমদানি করার অনুমতি দেয়। প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিবেশী ভারত থেকে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি পেয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
এর আগে জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে টানা কয়েক সপ্তাহ কাঁচা মরিচের কেজি ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল বাজারে। দাম কমাতে সরকারের নির্দেশনা, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের অভিযান - কোন পদক্ষেপেই যেন ঝাল কমছিল না মরিচের।
শেষ পর্যন্ত জুলাই মাসে সরকার কাঁচা মরিচ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ওই মাসের তিন তারিখে ভারত থেকে আমদানি করা কাঁচামরিচের ট্রাক বাংলাদেশের সীমান্তে ঢোকার সাথে সাথে পাইকারি ও খুচরা বাজারে কাঁচা মরিচের দাম কমতে শুরু করে। একদিনেই কাঁচা মরিচের দাম প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় নেমে আসে।
কেবল ডিম আর কাঁচা মরিচই নয়। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন চাল, পেঁয়াজ, বা রোজার সময়ে ছোলা বা খেজুরের দাম বেড়ে গেলে, এক পর্যায়ে সরকারকে সেসব পণ্য আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে। এমনকি গোশতের দাম নিয়ন্ত্রণে বিদেশ থেকে গোশত আমদানি করা হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ বলছে, বাজারে পণ্যের দাম নিয়ণ্ত্রণ করতে আমদানি করা একটি ‘সাময়িক’ পদক্ষেপ। কিন্তু বিশেষজ্ঞ এবং বাজার পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, দাম কমাতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে আমদানি না করে, বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
আমদানিতে যে সমস্যা :
১. আমদানি করতে প্রয়োজন ডলার। ডলার খরচ করে আমদানি করলে দেশী বাজারে তাৎক্ষণিক কোন পণ্যের দাম কমতে পারে, কিন্তু ডলারের ব্যবহার বেড়ে যায়। এমনিতে দেশে ডলারের সংকট। তার উপর ডলারের ব্যবহার যত বাড়বে, চাহিদা বেড়ে ডলারের দামও তত বেড়ে যায়। ফলে আপনি ডিম, কাচামরিচ, পেয়াজ আমদানি করে তাৎক্ষণিক কিছু দাম কমালেন ঠিক, কিন্তু ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আপনার আমদানি করা জ্বালানি তেল, গ্যাসের দামও বেড়ে যাবে। আর জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে আপনার সমস্ত পণ্যের পরিবহণ খরচ বেড়ে যাবে। আর পরিবহণ খরচ বেড়ে গেলে আপনার ব্যবহৃত সকল পণ্যের দাম বাড়বে। অর্থাৎ আমদানি করে হয়ত ৪-৫টা পণ্যের দাম তাৎক্ষণিক কমালেন, কিন্তু পার্মানেন্ট বেড়ে গেলো ২০-২৫টা পণ্য ও সেবার মূল্য। ফলে লাভের থেকে ক্ষতি বেশি হলো।
২. লক্ষ্য করবেন, যে কোন পণ্য আমদানি করতে একটি অতি উৎসাহী মহল সব সময় সক্রিয় থাকে। মূলতঃ এই অতি উৎসাহী মহলটি টাকা পাচারকারী চক্র জড়িত। আমদানির আড়ালে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে টাকা পাচার করাই, তাদের অতি উৎসাহের কারণ।
৩. লম্বা সময় ধরে কোন পণ্যের আমদানি অব্যাহত থাকলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তখন কতিপয় বড় ব্যবসায়ীর হাতেই থাকবে পণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণ। এরকম পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিলে সিন্ডিকেট করে উক্ত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিলে ক্রেতার কিছুই করার থাকে না, ক্রেতা বাধ্য হয় উচ্চমূল্যে পণ্য কিনতে।
স্থায়ী সমাধান কোথায় ?
দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে কৃষজপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির মূল কারণ বিভিন্ন ধাপে উন্নত প্রযুক্তি ও কার্যপদ্ধতির ব্যবহার না থাকা। এতে উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, বাজারজাতে পণ্যের খরচ বেড়ে যায়, ফলে জনগণকেও উচ্চমূল্যে পণ্য ক্রয় করতে হয়। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের হয়ত ভূমি অনুর্বর, কিন্তু তারা কৃষজ পণ্য জনগণের কাছে অনেক সস্তায় পৌছাতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, নিজ দেশের চাহিদা পূরণ করে তারা বিদেশেও রফতানি করে। এসবের মূল কারণ বিভিন্ন ধাপে তারা উন্নত প্রযুক্তি ও কার্যপদ্ধতি ব্যবহার করতে পেরেছে।
বাংলাদেশের পণ্যের দাম কমাতে তাই বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি নয়, বরং বিদেশী রাষ্ট্রের যে প্রযুক্তি ও কার্যপদ্ধতির কারণে তারা সস্তায় পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করতে পারছে সেই প্রযুক্তি ও কার্যপদ্ধতি আমদানি করা দরকার। তবে শুধু প্রযুক্তি ও কার্যপদ্ধতি আমদানি করলেই হবে না, সেগুলো কিভাবে ব্যবহার করবে এবং মেইনটেনেন্স করবে তার জন্য দরকার পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ। নয়ত প্রযুক্তি কিছু দিন পর জঞ্জাল হয়ে পড়ে থাকবে, কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। যেহেতু আমাদের দেশের ভূমি উর্বর, তাই এ পদ্ধতিতে আমাদের উৎপাদন অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি হবে এবং পণ্যের দামও আরো কম রাখতে পারবো আমরা। তখন আমাদের নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব হবে। ফলস্বরূপ দেখা যাবে, আজকে যেসব দেশ থেকে আমরা সস্তায় পণ্য আমদানি করছি, তখন আমরা উল্টো সেসব দেশে পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবো ইনশাল্লাহ।