প্রসঙ্গ ড্রাগন ফলে টনিক ব্যবহার :
দেশী উৎপাদিত ফল নিয়ে অপপ্রচার, বিদেশী ফল নিয়ে নেই কেন?
-মুহম্মদ শফিউর রহমান
সম্প্রতি দেশে উৎপাদিত ড্রাগন ফল নিয়ে একটি মহল বিভ্রান্তি তৈরী করছে। ‘ড্রাগন ফল কিভাবে এত বড় হয়’ এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করে দাবী করা হচ্ছে, বিষাক্ত রাসায়নিক বা টনিক ব্যবহার করে এর আকার বড় করা হচ্ছে। দাবী করা হচ্ছে, টনিক ব্যবহৃত ড্রাগন ফল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অথচ বাস্তবে ড্রাগন ফল চাষে ব্যবহার করা হয় এক ধরনের গাছ বৃদ্ধির পিজিআর হরমোন, যা আপেল, নাশপাতি বা মিষ্টি চেরিতে বহু দেশেই ব্যবহার করা হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তা ড. মেহেদি এ সম্পর্কে বলেছেন, “বাজারে ড্রাগন ফল নিয়ে যে অপপ্রচার হচ্ছে সেটা মোটেও ঠিক নয়। কারণ, পৃথিবীর সব দেশে ফল বড় করা এবং ফুল বেশি হওয়ার জন্য পিজিআর ব্যবহার করা হয়। এর ব্যবহারে কোনও স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। বিজ্ঞানের এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে যদি আমাদের চাষি ভাইয়েরা ফলের আকার বড় করেন, সেখানে স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। কারণ, এটি প্রাকৃতিক এবং অরগানিক সাবস্টেন্স। একটা সম্ভাবনাময় ফল কিছু অতি উৎসাহী ইউটিউবারের কারণে তো ধ্বংস হতে পারে না। (তথ্যসূত্র: বাংলাট্রিবিউন, শিরোনাম- ড্রাগন ফল নিয়ে বিভ্রান্তি, তারিখ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩)
আসলে দেশী উৎপাদিত ফল নিয়ে বিভ্রান্তি এই প্রথম নয়, এর আগেও আম, কলা, লিচু নিয়ে নানান বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। যেমন- আমে ফরমালিন দেয়ার নাম করে হাজার হাজার টন আম ধ্বংস করা হয়েছে। অথচ ফলমালিন দিয়ে প্রোটিন সংরক্ষণ করে, শর্করা বা সেলুলোজ নয়। হাজার হাজার টন আম ফরমালিনের নামে ধ্বংস করার পর গবেষকরা স্বীকার করে, ফরমালিনের কথা বলে আম ধ্বংস করা ভুল ছিলো। এমনকি যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন মাপা হয়, সেটাও ভুল। ( তথ্যসূত্র: জাগো নিউজ ২৪, শিরোনাম- ‘আমে ফরমালিন নিরোধ অভিযান শতভাগ ভুল ছিল’, তারিখ: ২৪ মে ২০১৭)
এরপর আসলো ইথোফেন দিয়ে ফল পাকানোর কথা। ইথোফেন দিয়ে ফল পাকালে ফল বিষাক্ত হয়, এমন দাবী করে টনকে টনকে ফল ধ্বংস করা হলো। কয়েক বছর ফল ধ্বংস করার পর বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সেমিনার করে বললো, ইথোফেন দিয়ে ফল পাকানো হলে সেই ফলে স্বাস্থ্যঝুকি হয় না। তারা আরো বললো, বিশ্বে ইথোফেনের মাধ্যমে বহু দেশে ফল পাকানো হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে যেভাবে ফল ধ্বংস করা হচ্ছে সেটা মূলত ইথোফেন সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জানার কারণে। (তথ্যসূত্র: দৈনিক কালেরকণ্ঠ, শিরোনাম- বিএফএসএর কর্মশালা : ‘ইথোফেন দিয়ে ফল পাকালে স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই’, তারিখ: ২৪ মে, ২০১৮)
কার্বাইড ব্যবহার করে ফল পাকানোর ক্ষেত্রেও একই বিষয়। কার্বাইড মানে হিট বা গরম দিয়ে ফল পাকানো। কার্বাইড দিয়ে ফল পাকালে কি ফল বিষাক্ত হয়? এর উত্তরে ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির পরীক্ষকরা বলেন, “কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফলের গায়ে আর্সেনিক ও ফসফরাস লেগে থাকতে পারে। এটা ক্ষতিকর উপাদান, কিন্তু আম ও কলা যেহেতু ছিলে খাওয়া হয়, সেহেতু ক্ষতির আশঙ্কা নেই। ” (তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, শিরোনাম- ‘আম নিয়ে আতঙ্ক নয়’, তারিখ- ২৩ মে ২০১৮)
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, দেশে উৎপাদিত কোন ফল হলেই, সেটা নিয়ে একটা মহল বিভ্রান্তি ছড়ায়। নানান সত্য মিথ্যা বলে সেই ফলকে বিষাক্ত বলে মানুষকে তা খেতে নিরুৎসাহিত করে। কৃষকদের ক্ষতির মধ্যে ফেলে দেয়, দেশী ফলকে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে ফল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। রাজধানীর ফলের আড়ৎ বাদামতলিতে গেলে দেখা যায়, কি বিপুল পরিমাণে ফল প্রতিদিন বিদেশ থেকে আসছে। অথচ এইসব আমদানি করা ফল কিভাবে উৎপাদিত হয়, সংরক্ষিত হয়, কি দিয়ে পাকানো হয়, এ সমস্ত ফলে কোন বিষাক্ত উপাদান আছে কি নাই, এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ভালে না মন্দ এগুলো নিয়ে কখনও কাউকে কোন কথা বলতে দেখা যায় না। আমদানি করা ফল নিয়ে সরকার, মিডিয়া, নিরাপদ খাদ্য, ভ্রাম্যমান আদালত একেবারেই চুপ, কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। যেন- আমদানি করা ফল মানেই ঝুকিহীন, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর জিনিস। অপরদিকে দেশে উৎপাদিত ফল মানে বিষে ভরা বস্তু, সন্দেহজনক, “তাই সাবধান! দেশী উৎপাদিত ফল খাবেন না। ”
আমার মনে হয়, দেশে উৎপাদিত ফলের বিরুদ্ধে নানান অপপ্রচার চালিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা, কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত করা একটি বিশেষ মহলের কারসাজি। তারা চায় দেশে ফল উৎপাদন না হোক, বরং বাংলাদেশের মানুষ বিদেশ থেকে আমদানি করা ফলের উপর নির্ভরশীল হোক। মূলত এই কারণেই দেশে উৎপাদিত ফল নিয়ে এত অপপ্রচার।