ছবিতে দুর্নীতি, ফিঙ্গারপ্রিন্টে মুক্তি
-মুহম্মদ এস হাবীব
বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারি কোন কাজে ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন বা অন্তর্ভূক্তি হতে গেলে এক বা দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিতে হয়। যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এই ছবি কেন নিচ্ছেন? উত্তর হবে, “পরবর্তীতে আপনাকে সনাক্ত করা হবে এই ছবি দেখে”। কথা হচ্ছে, বর্তমানে সময়ই তো এই ছবির সাথে আমার চেহারা মিলে না, আরো এক-দু্ই বছর পর তো আরো মিলবে না। তখন ছবির সাথে আমাকে মিলাবেন কিভাবে? এসএসসি, এইচএসসি কিংবা ভার্সিটি পরীক্ষার সময় পরীক্ষক স্যার/ম্যাডাম আমার স্বাক্ষর নেয়ার সময় দেখতাম অনেকক্ষণ চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কারণ ছবির চেহারার সাথে আমার চেহারায় মিল পেতে তাদের কষ্ট হতো।
এই যে ছবি দেখে পরিচয় সনাক্ত করার চেষ্টা করা, এটা একটা পুরাতন, জটিল ও দুর্নীতিবান্ধব পদ্ধতি। ছবি দিয়ে কখনই নির্ভুলভাবে কারো পরিচয় যাচাই বা সনাক্ত করা সম্ভব হয় না। অথচ এই ত্রুটিযুক্ত পদ্ধতিটাই এখন সমাজে বহুল ব্যবহৃত।
যেমন- দুইজন মানুষের চেহারায় অনেক সময় মিল থাকে। জমজ ভাই, খালাতো ভাই, মামাতো ভাই, এমনকি দূর সম্পর্কের মানুষের চেহারার মিলও থাকে। সেক্ষেত্রে একজন যদি আরেকজনের পরিচয় ব্যবহার করে কোন কাজ করে, তবে ছবি দিয়ে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। এই কাজটা হয় বিভিন্ন পরীক্ষার হলে প্রক্সি দেয়ার ক্ষেত্রে। দুইজনের চেহারা মিল থাকলে একজনের পরিবর্তে অন্যজন প্রক্সি পরীক্ষা দেয়। ভর্তি পরীক্ষা, চাকুরী পরীক্ষায় এখন প্রক্সি বহুল আতঙ্কের শব্দ।
গত ৩ নভেম্বর, ২০২১ তারিখে দৈনিক সকালের সময় পত্রিকায় ‘মাসুদ সরকার : প্রক্সি দেয়া তার পেশা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিলো। যেখানে দেখা যায় একটি চক্র, চেহারা মিল বা কাছাকাছি চেহারার লোক দিয়ে একজনের বদলে অন্যজনকে দিয়ে প্রক্সি পরীক্ষা দিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এই সমস্যা যে শুধু পরীক্ষার হলে তা নয়, বরং অপরাধীদের ধরতেও বড় সমস্যা। অনেক অপরাধী চেহারা পাল্টে ঘুরে বেড়ায়, তাই চেহারার ছবি দিয়ে তাকে সনাক্ত করা যায় না। এমন ঘটনা ধরা পড়ে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায়। বিল্লাল হোসেন নামক মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এক আসামী ৭ বছর ধরে হিজরা বেশে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু চেহারার সাথে ছবি মিল না থাকায় তাকে ধরতে ৭ বছর কষ্ট করতে হয় পুলিশকে। (তথ্যসূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ অনলাইন ভার্সন, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২)
ছবি বা চেহারাকে পূঁজি করে যে শুধু অপরাধী লুকিয়ে থাকে ব্যাপারটা এমন নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে চেহারার মিল থাকায় নিরাপরাধ লোক অপরাধীর বদলে জেলে ঢুকে যায়। যেমন- ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে ২০১৪ সালে আবু সালেক নামক এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। এতে পুলিশ চেহারার মিল দেখে গ্রেফতার করে এক ব্যক্তিকে। কিন্তু ৩ বছর পর বুঝা যায়, সেই ব্যক্তি আসলে আবু সালেক না, গ্রেফতার করা ব্যক্তির নাম জাহালম। (তথ্যসূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯)
আবার চট্টগ্রামের আলোচিত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যা মামলার কথা অনেকেই জানেন। সেই মামলার অন্যতম আসামী ছিলো আবদুল মোতালেব ওরফে ওয়াসিম নামক এক ব্যক্তি। পুলিশ ওয়াসিমের মত চেহারার এক লোককে গ্রেফতার করে যার নাম শাহজামান। যার চেহারার সাথে ওয়াসিমের চেহারার হুবুহু মিল। কিন্তু ওয়াসিম আর শাহজামান যে এক ব্যক্তি নয়, এটা পুলিশের বুঝতে সময় লেগেছে ১ বছর। (তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ৫ জুলাই, ২০১৭)
চেহারা বা ছবির মিলকে কাজে লাগিয়ে আরো বহু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে অন্যতম রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ যাওয়া। সাধারণত রোহিঙ্গাদের চেহারা বাংলাদেশীদের চেহারার কাছাকাছি হয়। এই মিলকে কাজে লাগিয়ে প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশীদের পরিচয় ব্যবহার করে পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। (তথ্যসূত্র: ডয়েচে ভেলে, তারিখ: ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, শিরোনাম- রোহিঙ্গারা যেভাবে বাংলাদেশি ভুয়া পাসপোর্ট পায়)
শুধু এতটুকই নয়, ছবি বা চেহারার মিলকে কাজে লাগিয়ে একজনের জমি অন্যজনের নামে রেজিস্ট্রি করা, আরেকজনের ত্রাণ বা ভাতা হাতিয়ে নেয়া, একজনের স্থানে অন্যজন জেল খাটা-মামলায় হাজিরা দেয়া (আয়নাবাজি), একজনের নাম করে অন্যজন ব্যাংক থেকে লোন উত্তোলন এমন বহু অপরাধ ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে ও ঘটছে।
আবার আধুনিক যুগে এআই বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি আসায় চেহারার ছবি দিয়ে দুর্নীতি করা আরো সহজ হয়ে গেছে। বর্তমানে এআই দিয়ে দুইজন মানুষের ছবি মিল করে একটি কমন ছবি তৈরী করা সম্ভব, যা দুইজনই নিদ্বির্ধায় ব্যবহার করতে পারে। ফলে সেই ছবি একসাথে দুইজন ব্যবহার করলেও খালি চোখে পার্থক্য ধরা সম্ভব না।
ছবি বা চেহারা মিলকে পূঁজি ব্যাপক দুর্নীতি ও অপরাধ সংগঠিত হওয়ায় এখন সবাই ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে সনাক্তকরণের দিকে ঝুকছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপ হচ্ছে এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যা পৃথিবীর ১ জন মানুষের সাথে অন্যজনেরটা কখনই মিলবে না। শুধু তাই নয়, দুইজন জমজ ভাই বা বোনের ফিঙ্গারপ্রিন্টও কখনও এক হবে না। এছাড়া গণ মানুষের মধ্যে ১ জনের পরিচয় যাচাইয়ের জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিকল্প নাই। অর্থাৎ ১ কোটি লোকের মধ্যে একজন ব্যক্তিকে ছবি দিয়ে কখনও সত্য-মিথ্যা যাচাই করা সম্ভব হয় না, কিন্তু ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে নিমিষেই তা করা সম্ভব।
এজন্য বাংলাদেশে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পরিচয় যাচাইয়ের জন্য এখন ফিঙ্গারপ্রিন্ট একমাত্র ভরসা। যেমন, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরীর সময় অটোমেটেড ফিঙ্গার আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এএফআইএস) নামক একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যেখানে ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাহায্যে কারো একাধিক পরিচয়পত্র আছে কি না, তা সহজেই বুঝা সম্ভব। আবার এ প্রযুক্তির সাহায্যে কোন রোহিঙ্গা পরিচয় গোপন করে বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিচ্ছে কি না, তাও সহজে বের করা হয়। ব্যাংকগুলোতে কেউ ভুয়া পরিচয়ে যেন ঋণ না তুলতে পারে এজন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণগ্রহিতার ফিঙ্গারপ্রিন্ট বাধ্যতামূলক করেছে। (তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, ২রা আগস্ট, ২০২৩)।
একইসাথে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধী যাচাইয়ের জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুব সহজেই অপরাধী সনাক্ত করছে।
যেমন- পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি ১০ হাজার অপরাধীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট সম্ভলিত তথ্য ভান্ডার তৈরী করেছে যেন কোন অপরাধীকে খুব সহজেই সনাক্ত করা সম্ভব হয়। এলিট ফোর্স র্যাব ‘অনসাইট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম’ (ওআইভিএস) নামক একটি প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে, যার মাধ্যমে যে কোন স্থানে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শুধু আঙুলের ছাপ দিয়ে অপরাধীকে সনাক্ত করা সম্ভব, এজন্য অপরাধীর কোন চেহারার দৃশ্যের প্রয়োজন হয় না। (তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা, ৪ মার্চ, ২০২১)
আমাদের পাশের দেশ ভারতেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট সনাক্তকরণ এখন বহুল ব্যবহৃত। সেখানে পরীক্ষার হলে প্রক্সি যাচাইয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ত্রাণ বা ভাতা উত্তোলনের সময়ও ফিঙ্গার যাচাই সেখানে বাধ্যতামূলক। এছাড়া বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের সময়ও ফিঙ্গারপ্রিন্টের ব্যবহার বাড়ছে। কারণ অনেক সময় কোন ব্যক্তি পূর্বের বিয়ের কথা লুকিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে। এই বিষয়টি এড়ানোর জন্য ভারতে বিয়ে রেজিস্ট্রেশনে ফিঙ্গার যাচাই চালু হয়েছে, যেন কেউ পূর্বের বিয়ের কথা লুকিয়ে বিয়ে না করতে পারে।
বাংলাদেশেও এখন কিছু স্থানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই চালু হচ্ছে। তবে সব সরকারী-বেসরকারি কাজে এখনও চালু হয়নি। এজন্য ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাথে দুই কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবিও নেওয়া হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, যেখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই নেই, সেখানে ছবি ব্যবহৃত হবে। এই যে ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাথে ছবিকে ঢুকানো হচ্ছে, এর মাধ্যমে আসলে দুর্নীতি করার সুযোগ দিয়ে দেয়া হচ্ছে। কারণ ছবি দিয়ে যাচাই মানে ত্রুটিযুক্ত যাচাই ও দুর্নীতি করার সুযোগ বিদ্যমান। সুতরাং যেখানেই ছবি দিয়ে যাচাইয়ের সুযোগ থাকবে, সেখান দিয়েই দুর্নীতি ঢুকবে। তাছাড়া আধুনিক যুগে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিভাইস খুবই সহজলভ্য ও স্বল্প দামে পাওয়া সম্ভব। যার কারণে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই সরকারী-বেসরকারী সব স্থানে জারি করা কোন ব্যাপার নয়, কিন্তু তারপরও কেন ছবি যাচাইয়ের সুযোগ রাখা হচ্ছে? এটা কি শুধু প্রযুক্তি ব্যবহারের অভাব নাকি দুর্নীতির সুযোগ রেখে দেয়া? প্রশ্নটা সেখানে।
বাংলাদেশ এখন স্ম্যার্ট বাংলাদেশ। সেখানে ব্যাকডেটেড, ত্রুটিযুক্ত ছবি দিয়ে যাচাইয়ের কোন সুযোগই থাকার প্রয়োজন নেই। তাই সকল ক্ষেত্রে পরিচয় যাচাইয়ে প্রাচীন ছবি প্রথা পুরোপুরি বাদ দিয়ে স্ম্যার্ট ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তি আনা এখন সময়ের দাবী।