এবারের যুদ্ধে ইসরাইলের যে সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি হলো
-মুহম্মদ এস হাবীব
গত ৭ই অক্টোবর, ২০২৩ তারিখ থেকে শুরু হওয়া ফিলিস্তিনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সংঘর্ষে ইসরাইল বেশ কিছু বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। আজকের আলোচনায় সে সমস্ত আলোচনা করবো।
(১) বিশ্বজুড়ে ইসরাইলের অন্যতম ব্যবসা হচ্ছে, গোয়েন্দা নজরদারি ব্যবস্থা (Surveillance System) –এর ব্যবসা। ইসরাইলকে বলা হয়, বিশ্বের গোয়েন্দা নজরদারি প্রযুক্তির কেন্দ্রস্থল। বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে এসব নজরদারি ব্যবস্থা বিক্রির মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার করে ইসরাইল। কিন্তু গত ৭ই অক্টোবর ইসরাইলে ফিলিস্তিনী মুক্তিযোদ্ধাদের করা হামলায় অনেকটাই প্রশ্নের সম্মুখিন হয়েছে দেশটির নজরদারি প্রযুক্তির ব্যবসা। সবার একটি প্রশ্ন, ইসরাইলের নজরদারি প্রযুক্তি যদি বাস্তবে এতটাই শক্তিশালী ও কার্যকর হয়, তবে তা দিয়ে নিজের দেশকে কেন বাঁচাতে পারলো না? কেন ৭ই অক্টোবরের হামলার খবর জানলো না? এ সম্পর্কে গত ২৬ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে ভারতের ‘দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন’ এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করে, “হামাসের হামলা সামাল দিতে ইরাইলের নজরদারি সিস্টেমের ব্যর্থতায় প্রশ্নের উদ্রেগ, ইসরাইল থেকে নজরদারি ব্যবস্থা কিনতে ভারতীয় কোম্পানি পূর্ণবিবেচনা করতে পারে”।
(২) ইসরাইলের অস্ত্রকে পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক সামরিক অস্ত্র নির্মাতা বলে দাবী হয়। স্টোকহোমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ইসরাইল থেকে অন্তত ৩৫টি দেশ ৩০২ কোটি ডলারের অস্ত্র আমদানি করেছে । ইসরাইলের মারাকাভা সিরিজের ট্যাংককে দাবী করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাধুনিক ট্যাংক। মারাকাভা ট্যাংকগুলেকে বলা হতো ‘গডের বাহন’। সেই অত্যাধুনিক ট্যাংকগুলো গাজায় প্রবেশ করার পর ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা যেভাবে নাজেহাল হয়েছে, তার দৃশ্য সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে। মাত্র ২শ’ ডলার খরচ করে স্থানীয়ভাবে বানানো ইয়াসিন রকেট দিয়ে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা যেভাবে সাড়ে ৩ মিলিয়ন ডলারের শত শত মারকাভা ট্যাংক ধ্বংস করেছে, তাতে ইসরাইলের সামরিক অস্ত্রের এতদিনের সুনাম নিঃশেষ হয়েছে, তা নিঃসেন্দেহে বলা যায়।
(৩) “ইসরাইলের সামরিক বাহিনী অনেক শক্তিশালী! মোসাদ অনেক চৌকশ! সারা বিশ্ব তাদের নিয়ন্ত্রণে !” এতদিন এমন অনেক গল্প বাজারে শোনা যেতো। কথায় বলে, ‘বনের বাঘের খায় না, মনের বাঘে খায়’, ইসরাইলীরা মনের বাঘ দিয়ে এতদিন সবাইকে ভয় দেখিয়ে রাখতো। কিন্তু এবারের সংঘাতে প্রমাণ করে দিয়েছে ইসরাইল এতদিন যা প্রচার করেছে সব ছিলো প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি (HOAX)। স্বল্প প্রযুক্তির হামাস সৈন্যদের কাছে তারা যেভাবে নাজেহাল হয়েছে, তাতে তাদের সামরিক, গোয়েন্দা ও কৌশলগত সক্ষমতা সব কিছু প্রশ্নবিদ্ধ। সবাই বলেছে, ইসরাইল আসলে পাওয়ার হাউস নয়, বরং কাগুজে বাঘ।
(৪) এ যুদ্ধে ইসরাইলের সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতি হয়েছে, তা হলো বিশ্বজুড়ে জনসমর্থন হারানো। হামাস নিমূর্লের কথা বললেও হামাস সৈন্যদের কিছুই করতে পারেনি ইসরাইলী বাহিনী। বরং সেই ক্ষোভ মিটিয়েছে তারা সাধারণ বেসামরিক লোকজনের উপর। বিমান হামলা করেছে হাসপাতাল, শরনার্থী শিবির, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপসানলয়গুলোর উপর। নির্বিচারে হত্যা করেছে সাধারণ মানুষকে। মাত্র ১ মাসে জীবন কেড়ে নিয়েছে প্রায় ১১ হাজার সাধারণ মানুষের, যার একটি বড় অংশ শিশু। শিশুদের লাশের সেই দৃশ্য পৃথিবীর বহু মানুষকে কাদিয়েছে। বিশ্বজুড়ে ইসরাইলকে সবাই সন্ত্রাসী ও দখলদার রাষ্ট্র বলে ধিক্কার দিয়েছে। ইসরাইলের এ নৃশংসতায় নতুন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন তো পরের বিষয়, যাদের সাথে এতদিন দেশটির কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিলো, সেটাতেও নাড়া লেগেছে। বাহরাইন, বলিভিয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তুরস্ক কূটনীতিক প্রত্যাহার করেছে।
(৫) ইসরাইলের সমর্থন এতটাই ঋণাত্মক অবস্থানে পৌছেছে যে, যেসব রাষ্ট্র প্রধানরা এতদিন ইসরাইলের প্রতি নরম সুরে কথা বলতো, তারাও বেঁকে বসছে। যেমন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো ইসরাইলের শিশু হত্যার নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসঙ্ঘে ইসরাইলি বসতির নিন্দা প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছে ইসরাইলের বন্ধু রাষ্ট্র ভারত। আরবদের মধ্যে নিজ জনসমর্থন ধরে রাখতে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমান ইসরাইলকে গণহত্যাকারী বলে ঘোষণা করেছে।
(৬) ইসরাইলি গণহত্যার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে বয়কট ইসরাইলী পণ্য ডাক উঠেছে। এর মাধ্যমে ইসরাইলী পণ্য তো অবশ্যই, প্রো-ইসরাইলী (ইসরাইলপন্থী) কোম্পানির পণ্যও পড়েছে। একই সাথে ইসরাইলে শাখা খোলা কোম্পানিগুলোও হুমকির মুখে পড়েছে। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে, কোন কোম্পানি ইসরাইলে ব্যবসা করতেই এখন ভয় করছে।
(৭) এ ঘটনায় মুসলমানদের যে উপকার হয়েছে, তা হচ্ছে বিভেদ ভুলে একমত হওয়া। সাধারণত সারা বিশ্বে মুসলমানরা বিভিন্ন দলাদলি, মত বিরোধে বিভক্ত। মুসলমানরা কোন ঘটনায় একমত হতে পারে না। কিন্তু এই একটি ঘটনায় প্রায় সারা বিশ্বের মুসলমান একমত হয়েছে, দল-মত ভুলে এক হতে পারা মুসলমান জন্য একটা বড় বিষয়। ‘মুসলমান জাতি একটি দেহের মত’ এই বাক্য অনেক স্থানে উচ্চারিত হয়েছে। কাফিররা এতদিন ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসিতে শত কোটি মুসলমানের দেহকে শক্তিহীন করে রেখেছিলো। সেক্ষেত্রে মুসলমানরা বিভেদ ভুলে অন্তত একটি বিষয়ে একমত হতে পেরেছে, ইহুদীবাদী শত্রুর বিরুদ্ধে কথা বলছে, আমি বলবো, এটা মুসলমানদের জন্য এক বিরাট বিজয় এবং ইসরাইলের জন্য বিরাট পরাজয়।