মুসলিম হিসেবে স্বাতন্ত্রবোধ বা স্বকীয়তা
কিছুদিন আগে অতিবাহিত হলো খ্রিস্টীয় নববর্ষ। বাংলাদেশেও একটা শ্রেণী উদযাপন করলো কথিত থার্টি ফাস্ট নাইট। রাত ১২টা বেজে ১ মিনিটে হই হুল্লো করে, বোমা ফাটিয়ে, আতশবাজি পুড়িয়ে, ফানুশ উড়িয়ে, ডিজে পার্টি করে, মদ খেয়ে নেচে গেয়ে তারা খ্রিস্টীয় নববর্ষকে বরণ করে নিলো।
খ্রিস্টীয় নববর্ষ পালন পশ্চিমা খ্রিস্টানদের সংস্কৃতি, বাংলাদেশ কিংবা মুসলিম সংস্কৃতি কোনটাই নয়। তবুও বাংলাদেশের এক শ্রেণীর নামধারী মুসলমান ইউরোপ-আমেরিকার খ্রিস্টানদের অনুকরণে এ দিবসটি পালন করলো। এমনকি পশ্চিমারা যে সমস্ত হারাম বিষয় (আতশবাজি, ডিজে, মদ) দিয়ে দিবসটি পালন করে, বাংলাদেশেও একই বিষয় দিয়ে দিবসটি পালনের চেষ্টা করলো নামধারী মুসলমান শ্রেণী।
আসলে যে শ্রেণীটি এমন করছে, তারা আসলে মুসলমান হিসেবে স্বাতন্ত্রবোধ ও স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। আমরা ইতিহাসে মুসলমানদের স্বর্ণযুগের যে কথা শুনি, তখন কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে স্বকীয়তা বা স্বাতন্ত্রবোধ ছিলো। কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে মুসলমান হিসেবে আমাদের স্বকীয় থাকতে বারবার নির্দেশ মুবারক করা হয়েছে, বলা হয়েছে ইসলামী আচার ও সংস্কৃতি বা সুন্নত সমূহকে আকড়ে ধরতে। বিপরীতে কাফির-মুশরিকদের সংস্কৃতি বর্জন করতে বলা হয়েছে। অসংখ্য হাদীস শরীফে পাওয়া যায় আখেরী নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইহুদী-নাসারাদের আমলের সাথে পার্থক্য বা খেলাপ করতে বলেছেন। এই যে স্বাতন্ত্রবোধ বা স্বকীয়তা সেটাই মুসলমানদের সারা বিশ্বের মধ্যে পৃথক করে দেয় এবং তারাই ধারাবাহিকতায় সারা বিশ্বে মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। আজ থেকে ৫-৬শ’ বছর আগেও দেখা যায়, যারা বর্বর জাতি ছিলো, তারা দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে জাতে উঠার চেষ্টা করতো। যেমন- চেঙ্গিস খান, হালাকু খানরা এক সময় বর্বর ও যাযাবর জাতি হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত ছিলো, কিন্তু তাদের পরবর্তী বংশধররা পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করে জাতে উঠে এবং সারা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়। দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করার পর সেই বংশধরদের মধ্যে মোঘল সম্রাট বাবর, হুমায়ুন কিংবা আলমগীর রহমতুল্লাহি এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। কিন্তু বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে স্বকীয়তা বোধ নষ্ট হয়ে গেছে, এখন মুসলমানরা নিজের সংস্কৃতি বাদ দিয়ে বর্বরদের সংস্কৃতি গ্রহণ করে জাতে উঠতে চাচ্ছে। নাউযুবিল্লাহ।
আসলে নিজের সংস্কৃতি বাদ দিয়ে অপরের সংস্কৃতি গ্রহণ করার ফলাফল কখন ভালো হয়। ছোটবেলায় আমরা ইশপের গল্পে কাক-ময়ূরের গল্প পড়েছিলাম। কাক ময়ুরের মেখম শরীরের সংযুক্ত করে ময়ুর সাজতে চায়, ময়ুরের সাথে নাচতে যায়, কিন্তু ময়ুরের দল কখনই কাককে গ্রহণ করে না। ঠোকর মেরে ভাগিয়ে দেয়। আরেকটু বড় হয়ে পড়েছি, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা। মধুসূদন ছিলো যশোরের হিন্দু, তার ইংরেজী ভাষা ও সংস্কৃতি ভালো লাগতো। সেই ভালোবাসা থেকে সে বাংলা বাদ দিয়ে ইংরেজী ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করে, খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে, নামের সাথে মাইকেল লাগায়। খ্রিস্টান নারী বিয়ে করে পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে চলে যায়। কিন্তু সেই ইংল্যান্ডের খ্রিস্টানরা তাকে গ্রহণ করেনি, তার সাহিত্যকেও গ্রহণ করেনি, তাকে জুলুম করেছে। ফলে অপদস্ত ও পর্যুদস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে মধুসূদন দত্ত।
আসলে যে কোন জাতি যদি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়, অন্যান্যদের উপর নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে চায়, তবে অবশ্যই সেই জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে স্বাতন্ত্রবোধ বা স্বকীয়তা থাকতে হবে। আমেরিকা ১৭৭৬ সালে ইংল্যান্ড থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু আমেরিকা নিজের অবস্থান দৃঢ় ও কর্তৃত্ব তৈরী করার জন্য নিজের মধ্যে থাকা ইংলিশ নিয়মনীতি ও কালচার থেকে পার্থক্য তৈরী করে। কিছু উদাহরণ দিলে বুঝতে সহজ হবে। যেমন- ইংল্যান্ড ও আমেরিকা দুই দেশের ভাষাই ইংরেজী, কিন্তু মার্কিন ইংরেজী আর ব্রিটিশ ইংরেজীর মধ্যে অনেক পার্থক্য। আবার ব্রিটিশ রাস্তায় গাড়ি চলে বাম দিয়ে, ফলে স্টিয়ারিং ডানে, অপরদিকে আমেরিকাতে গাড়ি চলে ডান দিক দিয়ে, ফলে স্টিয়ারিং থাকে বামে। আবার লাইট-ফ্যানের সুইচ অন-অফের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ নিয়ম হলো নিচে অন, উপরে অফ। অপরদিকে আমেরিকা করেছে উল্টা, মানে উপরে অন, নিচে অফ। লক্ষণীয় বাংলাদেশও এক সময় ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিলো, আমেরিকাও এক সময় ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিলো। কিন্তু বাংলাদেশে কিন্তু এখনও ব্রিটিশ নিয়ম-নীতি থেকে বের হতে পারেনি, মুসলমান হওয়ার পরও অনেকক্ষেত্রে পার্থক্য তৈরী করতে পারেনি। কিন্তু আমেরিকা নিজের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য খ্রিস্টান হওয়ার পরও স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রবোধ তৈরী করেছে, অর্থাৎ ব্রিটিশ নিয়ম-নীতির সাথে পার্থক্য তৈরী করেছে।
আসলে স্বকীয়তা মানে পৃথক অস্তিত্ব। স্বকীয়তা থেকে স্বাধীনতার সৃষ্টি। যে জাতির স্বকীয়তা নেই তার স্বাধীনতা-ই নেই। সে বস্তুত পরাধীন। এজন্য আগে একটা দেশকে পরাধীন করার জন্য সৈন্যবাহিনী অস্ত্র দিয়ে হামলা করা হতো। যুদ্ধ করে শক্তি দিয়ে দেশ দখলে নিতে হতো। কিন্তু এখন সেটা করা হয় না। টিভি, ডিশ এন্টেনা, সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ফলে দুই দেশের মধ্যে হাজার হাজার মাইল দূরত্ব, কিন্তু দুই দেশের সংস্কৃতি এক রকম হয়ে গেছে। সংস্কৃতি এক হয়ে যাওয়া মানে এমনিতেই দাসত্ব স্বীকার করে নেয়া। যার কারণে কথিত থার্টিফাস্ট আসলে অনেকেই মন্তব্য করে, “এটা কি বাংলাদেশ নাকি পশ্চিমের কোন খ্রিস্টান দেশ সে বুঝতে পারছে না। ” অর্থাৎ সংস্কৃতি দখল মানেই দেশ দখল।
এজন্য মুসলমানদের মধ্যে স্বাতন্ত্রবোধ বা স্বকীয়তা বোধ থাকা অত্যন্ত জরুরী। আমি একজন মুসলমান, আমার পোশাক, আশাক, চাল-চলন, কথা বার্তা, খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো-জাগা, চাকুরী-ব্যবসা-পড়ালেখা-চিন্তাধারা সবকিছুর মধ্যে মুসলমান হিসেবে স্বাতন্ত্রবোধ থাকতে হবে, কাফিরদের সাথে পার্থক্য থাকতে হবে। কাফিরদের সাথে মিলে গেলে হবে না। যারা বলে, “কাফিরদের মত করলে কি হয়? কি সমস্যা? আমরা এত মানুষ করছি, সবাই কি ভুল করছি”, তাদের বলতে হবে- হ্যা তোমরা ভুল করছো। তোমাদের স্বকীয়বোধ নেই, স্বাতন্ত্রবোধ নেই। তুমি বা তোমরা সংখ্যায় যত বড় হও, তোমরা পরাধীন, তোমরা বিলীন, তোমরা অস্তিত্বহীন। নদীর পানিতে ১ মন দুধ ফেললে সেই দুধ নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারবে না, নদীর পানিতে বিলীন হয়ে যাবে। আর ছোট একটা টুকরা মাখন ফেললে সেটা বিলীন হবে না, নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখবে। তুমি অস্তিত্বহীন দুধ, আর আমি অস্তিত্ব ধরে রাখা মাখন। দৃশ্যত্ব আমি যত ছোট হই, আমি যদি একজনও হই, আমার যদি মুসলমান হিসেবে স্বতন্ত্রবোধ থাকে, স্বকীয়তা থাকে, তবে আমারই অস্তিত্ব আছে। আমি শক্তি, আমি স্বাধীনতা, আমার থেকেই সৃষ্টি, আমার থেকেই ফিরবে মুসলমানদের স্বর্ণযুগ ইনশাল্লাহ।