সৌদি আরব কেন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে চায় ?

সৌদি আরব কেন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে চায় ?

 সৌদি আরব কেন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে চায় ?

লেখক- মুহম্মদ ইনজামামুল

 সম্প্রতি ফিলিস্তিন ও ইসরাইল সংঘাত শুরুর একটি বড় কারণ বলা হয়, সৌদি আরব দখলদার ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিলো। আর সৌদি আরব যদি ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেই ফেলতো, তবে তাকে অনুসরণ করে অনেক মুসলিম রাষ্ট্রই হয়ত দখলদার ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতো। ফলশ্রুতিতে বিশ্বে স্থায়িত্ব পেতো দখলদার ইসরাইল, আর হারিয়ে যেতো ফিলিস্তিন নামক মুসলমানদের আদি ভূমি রাষ্ট্রটি। সৌদিদের সেই কার্যক্রমকে বাধা দিতেই ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধারা গত ৭ই অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে দখলকৃত ইসরাইলের ভূমিতে গেরিলা হামলা চালায়, ফলে সাময়িক হলেও সৌদি-ইসরাইল সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হয়।

 কথা হচ্ছে, সৌদি কেন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে চাইছে, আজকের আলোচনা সে প্রসঙ্গে।

 মূলতঃ এর পেছনে রয়েছে, সৌদি ভিশন ২০৩০- নামক একটি পরিকল্পনা। যে পরিকল্পনা অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে সৌদি আরবকে নতুন করে সাজাতে চায় দেশটির ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমান। সৌদি প্রিন্সকে এই পরিকল্পনা তৈরী করে দেয়, বহুজাতিক কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাকিনজি’। ২০১৬ সালের ২৫শে এপ্রিল এই পরিকল্পনা ঘোষণা করে বিন সালমান। বর্তমানে সৌদি আরবে যে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাচ্ছে, তা এই সৌদি ভিশন ২০৩০ পরিকল্পনার অংশ বিশেষ।

 কি আছে সৌদি ভিশন ২০৩০ পরিকল্পনায় ?

এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সৌদির তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা। অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা। বিশেষ করে পর্যটন ও বিনোদনকে অগ্রাধিকার দেয়া। যেমন-

 ১. সৌদি আরবকে বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। এজন্য খেলাধূলায় বিপুল বিনিয়োগ করছে সৌদি আরব। স্প্যানিশ সুপার কাপের ম্যাচ এখন সৌদি আরবে হয়, পতুর্গিজ ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে বাৎসরিক ২১০০ কোটি টাকায়, ব্রাজিল ফুটবলার নেইমারকে বাৎসরিক ১৯০০ কোটি টাকায়, ফরাসী ফুটবলার করিম বেনজেমাকে বাৎসরিক ১১০০ কোটি টাকা দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে সৌদির পেশাদার ফুটবল লীগে, উদ্দেশ্য সারা বিশ্বের ফুটবল বিনোদনের নজর যেন ইউরোপের দিকে না থেকে সৌদির দিকে থাকে। আর্জেন্টিনার ফুটবলার মেসিকেও বানানো হয়েছে দেশটির পর্যটন দূত। একইসাথে ২০৩৪ সালে ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের ২৫ তম আসর সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে। পাশাপাশি সৌদিতে বিপুল টাকার বিনিময়ে আয়োজন করা হচ্ছে নারী ফুটবল, বক্সিং ও টেনিস টুর্নামেন্ট।

 শুধু দেশেই খেলাধূলা নয়, বরং বিদেশী খেলাগুলোতে বিপুল টাকা ইনভেস্ট করছে সৌদি আরব। যেমন- ইংলিশ ফুটবল ক্লাব নিউক্যাসলের মালিকানা কিনে নিয়েছে সৌদি। গলফের দুটি বড় ট্যুর পিজিএ এবং ডিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুরে ইনভেস্ট করেছে তারা। ২০২২ সালে ই-গেমে প্রায় ৩ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা ইনভেস্টে ঘোষণা এবং অতি সম্প্রতি ভারতীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আইপিএল-এ সৌদি সরকার ৫০ হাজার কোটি টাকা ইনভেষ্ট করতে প্রস্তাব দিয়েছে।

 ২. সৌদিতে পশ্চিমা সংস্কৃতি চালু করা সৌদি ভিশন ২০৩০ এর অন্যতম লক্ষ্য। ইতিমধ্যে দেশটিতে সিনেমা হল, নাইটক্লাব, কনসার্ট, চালু হয়েছে। পশ্চিমা খ্রিস্টান থেকে আগত ভুতের উৎসব হ্যালোইন প্রতি বছর সৌদি আরবে জাকজমকভাবে পালিত হচেছ।

 ৩. সৌদি ভিশন ২০৩০ এর অন্যতম লক্ষ্য হলো, সৌদি নারীদের ঘরের বাইরে কর্মক্ষেত্রে আনা। মোট কর্মক্ষেত্রের ৩০ শতাংশ নারী করা। এজন্য ২০১৬ সাল থেকে কাজ শুরু হয় এবং ২০২২ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার পূরণ হয়। এতদিন পশ্চিমা দেশগুলো থেকে নারীকে ঘরের বাইরে আনার কথা শোনা গেলেও এখন থেকে তা সৌদি আরব থেকেই শোনা যাবে। যার কারণে বর্তমানে (তারিখ: ৭ নভেম্বর, ২০২৩) দেশটিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক সম্মেলন। যে মুসলিম প্রধান দেশে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, সেই সব দেশের নারী রাষ্ট্রপ্রধানরা সেখানে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ পাবে।

 ৪. সৌদি ভিশন ২০৩০ পরিকল্পনায় সৌদি আরবের পরমাণু শক্তি ব্যবহার করা এবং সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রফতানির কথা বলা হয়েছে। যেহেতু সৌদি-ইসরাইল মধ্যস্থতাকারী হবে আমেরিকা, তাই সমঝোতা হলে ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের বিনিময়ে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও কিছু সুবিধা চাওয়ার আশা করছে। এই সুবিধার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে, সৌদির নিজস্ব পরমাণু কর্মসূচি এবং সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাওয়া।

 ৫. সৌদি ভিশন ২০৩০ এর অংশ হিসেবে দেশটির উত্তর-পশ্চিমে ‘তাবুক’ প্রদেশে একটি আধুনিক শহর তৈরী পরিকল্পনা নিয়েছে সৌদি সরকার, যার নাম ‘নিঅম সিটি’। সৌদিদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই শহরটিতে থাকবে কৃত্রিম চাঁদ, উড়ন্ত ট্যাক্সির ব্যবস্থা। বাড়িঘর পরিষ্কারের কাজ করবে রোবট, থাকবে সবুজ গাছপালা। এর আকার হবে ৩৩টি নিউইয়র্কের সমান। নিঅম শহরে জুরাসিক পার্কের মতো থাকবে রোবট ডাইনোসর। সৌদি যুবরাজের ইচ্ছা, প্রযুক্তির দিক থেকে শহরটি হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির মতো, বিনোদনের দিক থেকে হলিউডের মতো আর অবসর কাটানোর জন্য ফ্রান্সের ফ্রেঞ্চ রিভিয়ের সৈকতের মতো। এই শহরে সৌদির প্রচলিত আইনে চলবে না, তাদের নিজস্ব আইন থাকবে। শহরটি নির্মাণে বাজেট ধরা হয়েছে ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শহরটি নির্মাণে অনেক প্রযুক্তি দরকার, ইসরাইল-জর্ডান সীমান্তের কাছে হওয়া এবং পরিবেশগত মিল থাকায় এর অনেক (কৃষি, পানিসহ পরিবেশগত) প্রযুক্তি ইসরাইল থেকে আনতে হবে বলে শোনা যায়। যার কারণে ২০১৬ সালে সৌদি ভিশন ২০৩০ প্রকাশ পাওয়ার পর অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করে বসে, এই শহর নির্মাণ করতে গেলে বা তার সুফল পেতে হলে ইসরাইলকে সৌদির স্বীকৃতি দিতে হবে। পরবর্তীকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। দেখা যায় প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য সৌদি-ইসরাইল মিটিং এর কথা শোনা যেতে থাকে। ২০২০ সালে বিশ্বে বড় বড় মিডিয়ায় খবর আসে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রাইভেট জেট বিমানে চড়ে সৌদির নিঅম সিটিতে প্রিন্স বিন সালমানের সাথে গোপন মিটিং করে। যদিও বিষয়টি কোন দেশ স্বীকার করেনি। শোনা যায়, নিঅম শহরের অনেক কাজের কন্ট্রাক্ট ইসরাইলী কোম্পানিগুলো দেয়া হয়েছে, যার পরিমাণ শত বিলিয়ন ডলার। এছাড়া মিশর, ইসরাইল ও সৌদির নিঅম শহরের মধ্যে একটি ব্রীজ তৈরী হবে, যার নাম হবে কিং সালমান ব্রীজ। এই ব্রীজটি তিন দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরী করবে।

 অর্থাৎ সৌদি ভিশন ২০৩০ এর মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে সয়লাব হওয়া পর্যটন ও বিনোদনের কেন্দ্র হতে চায় সৌদি আরব। আর সেই লক্ষ্যেই ইসরাইলের সাথে সৌদির আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক তৈরী করতে ইচ্ছুক ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমান।

Comments