পর্দানশীন নারীদের মানবাধিকার থাকতে নেই লেখা : এস হাবীব

পর্দানশীন নারীদের মানবাধিকার থাকতে নেই <br>লেখা : এস হাবীব

পর্দানশীন নারীদের মানবাধিকার থাকতে নেই
লেখা : এস হাবীব


সালমা বেগম (ছদ্মনাম) একজন পর্দানশীন নারী। পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ মেনে পর্দা করেন বিধায় তিনি কখনও গাইরে মাহরাম পুরুষকে চেহারা দেখননি। শুধু তাই নয়, মুখমণ্ডলের ছবি তুললে সেটাও গাইরে মাহরামের কাছে যাবে বিধায় তিনি ছবি তুলেননি। আর ছবি না তোলার কারণে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডিও করতে পারেনি। কিন্তু এনআইডি না থাকায় তিনি প্রতিনিয়ত নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
যেমন-
১. দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে তিনি টিসিবি থেকে পণ্য নিতে চান। কিন্তু এনআইডি না থাকায় তিনি টিসিবি থেকে পণ্য নিতে পারছেন না।

২. বাসা ভাড়া নিতে গেলে বাড়িওয়ালাকে এনআইডি কার্ড দেখাতে হয়, কিন্তু সেটা না থাকায় বাসা ভাড়া নিতে তার কষ্ট হয়।

৩. এনআইডি না থাকায় তিনি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছেন না।

৪. পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য পর্দার সহিত তিনি কোথাও চাকুরী করতে চান। কিন্তু এনআইডি না থাকায় তাকে কেউ চাকুরীতে নেয় না।

৫. সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য সেবা নিতে গেলে এনআইডি লাগে। কিন্তু সেটা না থাকায় তিনি ঠিকমত স্বাস্থ্য সেবা নিতে পারছেন না।

৬. ট্রেনে করে যাতায়াত করতে গিয়ে দেখলেন আইডি কার্ড ছাড়া তিনি টিকিট কাটতে পারছেন না।

৭. বন্যার সময় সরকারি ত্রাণ নিতে গিয়ে দেখলেন, আইডি কার্ড ছাড়া তাকে ত্রাণ দিচ্ছে না ।

৮. বাবার পেনশনের টাকা তুলতে গিয়ে দেখলেন আইডি কার্ড ছাড়া পেনশনের টাকা বন্ধ।

৯. ওয়ারিশত্রুতে প্রাপ্ত সম্পত্তি নিজের নামে রেজিস্ট্রি করতে পারছেন না। খুব আর্থিক সংকট হলে বিক্রিও করতে পারছেন না।

১০. নিজের নামে মোবাইল সিম তুলতে পারছেন না।

১১. বিয়ের সময় কাবিননামা করতে নাকি এনআইডি লাগে। সেটা তো নেই।

১২. কোন কারণে নির্যাতিত হলে আইনের দারস্থ হতে হলেও এনআইডি লাগে। সুতরাং আইনী অধিকার থেকেও বঞ্চিত।

অর্থাৎ শুধুমাত্র মুখমণ্ডলে ছবি না তোলায় একজন পর্দানশীন মহিলা শিক্ষার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার, কর্ম করার অধিকার, আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকারের মত মৌলিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা একটি চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন।

অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে- রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ১২ অনুচ্ছেদে বলা আছে, “কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য করবে না। ” মৌলিক অধিকার অংশে ২৮ (১) অনুচ্ছেদেও একই কথা বলা হয়েছে, “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।”

সংবিধানের এ ধারা মানতে খ্রিস্টানদের এক উপদলের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলাদেশের শিক্ষাবোর্ড সম্প্রতি পৃথক পরীক্ষা পদ্ধতির ব্যবস্থা করে। খ্রিস্টানদের প্রোটেস্ট্যান্ট নামক দলের মধ্যে ‘সেভেন্থ ডে এডভান্টিস্ট’ নামক উপদল রয়েছে, যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস- সূর্য ডোবার আগে পড়ালেখা নিষিদ্ধ। তাই তাদের ধর্মবিশ্বাস অনুসারেই সন্ধার পর পৃথক পরীক্ষা ব্যবস্থা করে রাষ্ট্র। দেখা যায়, বোর্ডের যেসব হলে তাদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়, সেখানে সেই ধর্মের শিক্ষার্থী সংখ্যা মাত্র ১ জন। (সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন অনলাইন, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২)

আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, খ্রিস্টান একটি মাত্র ছেলের জন্য পৃথক পদ্ধতির ব্যবস্থা করা হলেও বাংলাদেশে অসংখ্য পর্দানশীন নারীদের জন্য পৃথক কোন আইডি কার্ডের ব্যবস্থা করা হয়নি। আরো আশ্চর্জনক বিষয় হচ্ছে, যে ছবির জন্য পর্দানশীন নারীরা আইডি কার্ড নিতে পারছেন না, “জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০” আইনে একজন ব্যক্তিকে সনাক্তকরণে মুখচ্ছবিকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি, গ্রহণ করা হয়েছে বায়োমেট্রিক ফিচারকে, যার মধ্যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বহুল ব্যবহৃত। কিন্তু তারপরও শুধু গায়ের জোরে জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য ছবি চাওয়া হচ্ছে, আর সে কারণে সালমা বেগমের মত অসংখ্য পর্দানশীন নারী বঞ্চিত হচ্ছেন মৌলিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে। ছবির মত একটি অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত নিয়মের ফলে কত লক্ষ কোটি সালমা বেগমের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তার হিসেব কে রাখবে ?

Comments