পীর সাহেব, ওলী আউলিয়া গণের নামে কুৎসা রটনার পেছনে কে ?

পীর সাহেব, ওলী আউলিয়া গণের নামে কুৎসা রটনার পেছনে কে ?

 পীর সাহেব, ওলী আউলিয়া গণের নামে কুৎসা রটনার পেছনে কে ?

লেখক: ‍মুহম্মদ গোলাম সামদানী

 আমাদের সমাজে ‘পীর’ শব্দটার প্রতি এক ধরনের এলার্জি বিদ্যমান। ‘পীর’ শব্দটা শুনলে কারো কারো মনের মধ্যে উদয় হয়, মনে হয় লাল কাপড় পরিহিত কোন ব্যক্তি, যার লম্বা লম্বা জট বাধা চুল। পীরের দরবারে সবাই বোধ হয় গান-বাজনা করে, যেখানে একটি মাজার আছে, যেখানে সবাই ‘সেজদা’ করে। নাউযুবিল্লাহ।

 এ ধরনের চিন্তার উদ্ভবের কারণ পাঠ্যবই, নাটক-সিনেমায় ‘লালসালু’ টাইপ গল্পের প্রচার। এর মাধ্যমে সবাইকে পীর সাহেব, ওলীআল্লাহ সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণা দেয়া হয়েছে। আর সেই ধারণা থেকেই এ ধরনের উদ্ভট চিন্তাধারার সূচনা।

 আসলে সমাজে প্রত্যেকটা জিনিসের ভালো মন্দ আছে। বাজারে যেমন ভালো মাল আছে, তেমনি মন্দ মালও আছে। মন্দ মালের জন্য নিশ্চয়ই কেউ ভালো মাল কেনা বন্ধ করে না। আবার সমাজে ভালো মানুষ আছে, মন্দ মানুষও আছে। মন্দ মানুষের কথা ভেবে নিশ্চয়ই মানুষ সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে না। ঠিক তেমনি সমাজে পীর সাহেব-ওলী আল্লাহ নাম করে ভণ্ড শ্রেণী থাকতে পারে, যারা হয়ত শরীয়ত বিরোধী কাজ করে। কিন্তু তাদের জন্য ওক্কানী, পীর সাহেব বুজুর্গ, ওলী আল্লাহ গণ খারাপ হয়ে যান না।

 সমাজে কারা পীর সাহেব, ওলী আউলিয়া সম্পর্কে খারাপ চেতনা তৈরী করেছে, এ বিষয়টি একটু অনুসন্ধান করলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। যেমন, লেখার শুরুতে ‘লালসালু’ উপন্যাসের নাম এনেছি, যার রচয়িতার নাম সৈ: ওয়ালীউল্লাহ। তার বাবা ছিলো ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, মামা ছিলো ব্রিটিশদের থেকে খান বাহাদুর উপাধিপ্রাপ্ত। সৈ: ওয়ালীউল্লাহ নিজেও ছিলো ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত এবং তার সাহিত্যের মাধ্যমে সেই বিলেতি সংস্কৃতির প্রচার হয়েছে। সে মারাও গেছে ইউরোপে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রিটিশদের আর্শিবাদপ্রাপ্ত এ লোকগুলো কেন ওলী আউলিয়া, পীর সাহেবদের বিরোধীতা করতো ?

 আসলে শত শত বছর আগে এ অঞ্চলে ব্রিটিশরা অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করে, তখন তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলো পীর সাহেব, ওলীআল্লাহ বা সূফী ধরণের ব্যক্তিদের দ্বারা। উনারা জিহাদ করে ব্রিটিশদের আটকানোর চেষ্টা করেন। যেমন- আমরা পাঠ্যবইয়েই পড়েছি, ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে এসে প্রথম যে বাধার সম্মুখীন হয়, তার নাম ছিলো ফকির-সন্নাসী বিদ্রোহ। আমাদের নতুন প্রজন্ম ফকির বলতে বুঝে দরিদ্র মানুষকে। কিন্তু ফকির আসলে আরবী শব্দ। দুনিয়াবিরাগী সুফী পীর সাহেব ওলীআল্লাহ উনাদের একটি উপাধি হলো ফকির। ফকির-সন্নাসী বিদ্রোহ নামক যে ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধের কথা আমরা শুনি, তার নেতৃত্ব ছিলেন পীর মজনু শাহ, যিনি মাদারিয়া নামক একটি তরিকার সূফী ছিলেন। ১৭৭০ সাল থেকে প্রায় ২৬ বছর তিনি প্রায় ৫০ হাজার সূফীকে নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী জিহাদের নেতৃত্ব দেন। উনার জিহাদের কারণে ব্রিটিশদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

 তবে ‘ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হবে’ এ চেতনার মূল সূচনা করেছেন সূফী পীর সাহেব হযরত শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি ব্রিটিশ শাসিত হিন্দুস্তানকে ‘দারুল হারব’ ঘোষণা করে ফতওয়া দেন। উনার ফতওয়ার কারণে ‘ব্রিটিশবিরোধী’, এই চেতনা ব্যাপকভাবে প্রচার লাভ করে। পরবর্তীতে উনারই মুরিদ ও প্রধান খলিফা সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী রহমতুল্লাহি এ অঞ্চলে ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধের মূল নেতৃত্ব দেন। তিনি নিজেও পীর সাহেব, ওলীআল্লাহ সূফী ছিলেন। তিনি উনার মুরিদেরকে নিয়ে ব্রিটিশ ও তাদের অনুচর শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং শহীদ হন। এ অঞ্চলে পরবর্তীকালে যত ব্রিটিশবিরোধী জিহাদের ঘটনা ঘটে, সবগুলো ছিলো উনার তরীক্বার বা পরবর্তী মুরিদদের থেকে। ইতিহাসের পাতায় ব্রিটিশ বিরোধী তীতুমীরের বাঁশেরকেল্লার যে কথা শোনা যায়, সেই তীতুমীর (মূল নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর রহমতুল্লাহি) ছিলেন সৈয়দ আহমেদ শহীদ বেরেলভী রহমতুল্লাহির মুরিদ।

 সৈয়দ আহমেদ শহীদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি সম্পর্কে কবি ফররুখ আহমেদ ‘রায় বেরেলীর জঙ্গি পীর’ কবিতায় লিখেছেন-

“সবাই যখন আরাম খুঁজে

 ছুটে ঘরের পানে

জঙ্গী (যোদ্ধা) পীরের ডাক শোনা যায়

জঙ্গের ই ময়দানে।

সবাই ভাবে পীরের কথা

শুনেছি তো ঢের

এমন পীরের কথা তো ভাই

পাইনি কভু টের।”

 ইতিহাসের পাতায় ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধে আমরা যে দক্ষিণ ভারতের মহীশূরের টিপু সুলতানের নাম শুনে থাকি, তিনিও ছিলেন একজন সূফী ঘরানার লোক। তিনি ছিলেন চিশতীয়া তরিক্বার অনুসারী। উনার বাবা উনার নাম রেখেছিলেন হযরত টিপু মাস্তান আওলিয়া চিশতী রহমতুল্লাহি নামক একজন পীর সাহেব ওলী আউলিয়ার নাম অনুসরণে।

 ব্রিটিশ বা উপনিবেশদের শাসনের বিরুদ্ধে যে শুধু এ অঞ্চলের সূফী-পীর সাহেবরাই অস্ত্র ধরেছিলেন বিষয়টি এমন নয়, বরং সারা বিশ্বের সূফী-পীর সাহেবগণ একই কাজ করেছেন। যেমন, বর্তমান ফিলিস্তিনে যুদ্ধরত হামাসের যোদ্ধা শাখা ইজ্জুদিন আল কাসসাম ব্রিগেডের নাম শোনা যায়। এই ইজ্জুদিন আল কাসসাম ব্রিগেড নামকরণ হয়েছে হযরত ইজ্জুদিন আল কাসসাম রহমতুল্লাহি’র নাম অনুসারে, যিনি কাদেরিয়া তরিকার একজন পীর সাহেব তথা শায়খ ছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে গিয়ে শহীদ হন। উনার চেতনা অনুসারে পরবর্তীতে হামাসের সশস্ত্র শাখা গঠিত হয়।

 কিন্তু ইতিহাস বলে, পীর সাহেব, ওলী আউলিয়ারা যখন কাফির উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন, ঠিক তখন ওয়াহাবী আকিদাভূক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলো ব্রিটিশদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। যেমন- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ওয়াহাবী আকিদাভূক্ত গোষ্ঠীগুলো ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় উসমানীয় সালতানাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যার পুরষ্কারস্বরূপ ওয়াহাবী মতবাদে বিশ্বাসী সৌদ পরিবারকে ব্রিটিশরা আরবের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। পরবর্তীকালে তারা তাদের পরিবারের নাম অনুসারে দেশটির নাম রাখে সৌদি আরব।

 অর্থাৎ ব্রিটিশরা তাদের শাসন বিস্তারে পীর সাহেব, সূফী, ওলী আউলিয়ার বিরোধীতার সম্মুখীন হয়, অপরদকে সহযোগী হিসেবে পায় ওলী আউলিয়া বিরোধী ওয়াহাবীদেরকে। এ কারণেই ব্রিটিশ ও তার সহযোগীরা পীর সাহেব, সূফী, ওলী আউলিয়া উনাদের কুৎসা রটনা করে, উনাদের নামে অপপ্রচার চালায়, যেন সাধারণ মানুষ পীর সাহেব, সূফী, ওলী আউলিয়া থেকে দূরে সরে যায়। মূলতঃ হক্কানী পীর সাহেব, সূফী, ওলী আল্লাহগণের নিকট এক ধরনের আধ্যাত্মিক শক্তি বা রূহানিয়াত থাকে, যার সংস্পর্শে আসলে মানুষ কাফেরদের শাসন-নিপীড়ন কখনই মেনে নিবে না। কাফিরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। তাই সাধারণ মানুষকে সূফী পীর সাহেবদের থেকে দূরে রাখতেই উনার নামে কুৎসা রটনা, ভুল তথ্য দিয়ে সাধরণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা। বর্তমানে পাঠ্যবই, মিডিয়া, পত্রিকাসহ বিভিন্ন স্থানে পীর সাহেব, সূফী, ওলী আউলিয়াদের যে বিরোধীতা হয়, তাই ঐ ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া পলিসি অনুসরণ করেই।

Comments