শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিক্ষা পেলে কি মুখস্ত শিক্ষার প্রয়োজন নাই?

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিক্ষা পেলে কি মুখস্ত শিক্ষার প্রয়োজন নাই?

 শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিক্ষা পেলে কি মুখস্ত শিক্ষার প্রয়োজন নাই?

-মুহম্মদ মুহিউদ্দিন রাহাত

 সম্প্রতি নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরী হওয়ার পর জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তা প্রফেসর মুহম্মদ মশিউজ্জামান এক বক্তব্যে বলেছেন, বর্তমান কারিকুলাম এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখবে, সেখানে মুখস্ত শেখার কোন স্থান নেই। একই সাথে তিনি বলেছেন, উনারা যেভাবে বলবেন, ইঞ্জিনিয়ারিং-মেডিকেল-জেনারেল ইউনিভার্সিটিগুলোগুলো সেভাবেই তাদের ভর্তি মূল্যায়ন ঠিক করে নেবে, তাই অভিভাবকদের চিন্তা করার কিছু নেই।

 গত কয়েকদিনে প্রফেসর মুহম্মদ মশিউজ্জামান সাহেবসহ পাঠ্যক্রমের পক্ষের ব্যক্তিদের বিভিন্ন বক্তব্য শুনে কিছু কথা বলতে হয়-

 ১. একটা বইয়ে অনেক ধরনের জ্ঞান থাকে। এর কিছু অংশ শিক্ষার্থীরা বুঝে মুখস্ত করে, কিছু অংশ না বুঝে মুখস্ত করে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়িত্ব হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের প্রতিটি বিষয় বুঝিয়ে শেখানো। তবে সকল পাঠ সব সময় প্র্যাকটিকাল বা বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ সব অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ বা সময় কোনটাই সব সময় পাওয়া যায় না।

 ২. একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রচুর মুখস্ত করতে হয়। ছাত্র অবস্থায় তারা বইয়ে যত রোগের কথা পড়ে, ক্লাস প্র্যাকটিকাল, ইন্টার্নশীপ, এমনিক পেশাগত জীবনে গিয়েও সব সব রোগের বাস্তব উদাহরণ পাওয়া যায় না। কিন্তু তারপরও তাকে মুখস্ত করে রাখতে হয়। কারণ কখনো যদি একজন রোগী পেয়েই যায়, তবে মুখস্ত জ্ঞান থেকে যেন চিন্তার সমন্বয় করে নিতে পারে। কিন্তু বাস্তব রোগী না পাওয়া পর্যন্ত যদি মেডিকেল শিক্ষার্থী মুখস্ত না করে বসে থাকে, তবে তাকে আর ডাক্তার হতে হবে না।

 ৩. বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শেখানোর দায়িত্বটা আসলে শিক্ষকের। একজন শিক্ষক কোন একটি পাঠ দানের সময় ঐ পাঠের এক বা একাধিক বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরেন, তবেই বিষয়টি সহজে অনুধাবন করতে পারে শিক্ষার্থীরা। এজন্য শিক্ষকের মান উন্নয়ন বা ট্রেনিং আগে জরুরী।

 ৪. অনেকে বলে, “আগের কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টার আর গাইড বইয়ের দ্বারস্থ হয়। ফলে তাদের প্রচুর ব্যবসা হচ্ছে।” আসলে শিক্ষার্থীরা কোচিং বা গাইড বইয়ের দ্বারস্থ হচ্ছে, কারণ শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুসারে শিক্ষার যোগান শ্রেণী শিক্ষকরা দিতে পারছেন না। ফলে তাদের বিকল্প খুজতেছেই শিক্ষার্থীরা কোচিং কিংবা গাইড বইয়ের দিকে ঝুকছে। শিক্ষরা যদি শিক্ষার্থীদের চাহিদা ক্লাসেই পূরণ করে দিতো, তবে তাদের কোচিং বা গাইডের দ্বারস্থ হওয়ার ঘটনা অনেক কমে যেতো। অর্থাৎ এখানে সমস্যা শিক্ষকের মান নিয়ে, পাঠ্যবই বা কারিকুলামে না। কিন্তু শিক্ষকের মান উন্নয়ন না করে পাঠ্যবই-কারিকুলাম পরিবর্তন করে ফেলা হলো, এ কেমন উল্টো বিচার?

 ৫. মশিউজ্জামান সাহেব বললেন, “স্কুলের নতুন কারিকুলাম অনুসারে পরবর্তীতে ইঞ্জিনিয়ারিং-মেডিকেল-জেনারেল ইউনিভার্সিটিগুলো তাদের ভর্তি প্রক্রিয়ায় সংশোধন পরিমার্জণ করবে। ”

লক্ষ্য করুন, বর্তমানে বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণ কর্মক্ষেত্রের চাহিদা অনুসারে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কোয়ালিটি গ্রাজুয়েট যোগান দিতে পারছে না। এজন্য কর্মক্ষেত্রের চাহিদা অনুসারে ইঞ্জিনিয়ারিং-মেডিকেল-জেনারেল ইউনিভার্সিটিগুলোর শিক্ষা পদ্ধতি সাজানো উচিত। আবার ইঞ্জিনিয়ারিং-মেডিকেল-জেনারেল ইউনিভার্সিটিগুলোর চাহিদা অনুসারে কলেজগুলোর শিক্ষা পদ্ধতি সাজানো উচিত। আবার কলেজের চাহিদা অনুসারে স্কুলের শিক্ষা পদ্ধতি সাজানো উচিত। অর্থাৎ চাহিদাটা উপর থেকে নিচের দিকে নামবে। কিন্তু মশিউজ্জামান সাহেবের কথা অনুসারে তারা নিচ থেকে যেভাবে সাজিয়ে দেবে উপরের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সে অনুসারেই চলবে। এটা কেমন কথা ! এটা কি মার্কেটের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য কোন শিক্ষা পদ্ধতি? এর মাধ্যমে তো বেকারত্ব কখনই কমবে না, বরং প্রচুর পরিমাণে বাড়বে।

 ৬. বর্তমান কারিকুলামে একজন শিক্ষার্থীর থেকে অভিভাবক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কারণ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখার কথা বলে, বাচ্চাদের এমন সব এসাইনমেন্ট চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, যার যোগান বাচ্চারা দিতে পারছে না, ফলে বাচ্চারা বাবা-মায়ের কাছে এসে বলছে, আমাদের এসাইনমেন্ট করে দাও। বাধ্য হয়ে বাবা-মা কাজ-কর্ম ফেলে বাচ্চার এসাইনমেন্ট করতে মাঠে নামছেন। একজন বাচ্চাকে বলা হচ্ছে, অমুক তরকারি বাসা থেকে রান্না করে আনো। বাচ্চা বাসা থেকে মাকে দিয়ে মজার তরকারি রান্না করে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। আর শিক্ষকরা সবাই মিলে সেই তরকারি খেয়ে বাহবা দিচ্ছে, শিক্ষার্থীকে ত্রিভুজ দিচ্ছে। এই মূল্যায়ন দিয়ে গার্ডিয়ান মূল্যায়িত হবে, শিক্ষার্থী না।

 ৭. অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিক্ষার কথা যদি বলতে হয়, তবে প্রথমে বলতে হবে, সাইন্স সাবজেক্টগুলোর ব্যবহারিক ক্লাসের কথা। সত্যিই বলতে বাংলাদেশে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইন্সের ব্যবহারিক ক্লাসগুলো ঠিক মত হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্কুলগুলো একটা ফি ধরে, শিক্ষার্থীদের নম্বর দিয়ে দেয়। সাইন্সের কয়েকটি ব্যবহারিক ক্লাসে যেখানে স্বচ্ছতা থাকে না, সেখানে পুরো পাঠ্যক্রমে ব্যবহারিক বা অভিজ্ঞতা নির্ভর হবে এবং সেখানে শতভাগ স্বচ্ছতা রেখে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে, এটা আমরা বলতে পারি না। এ ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষকদের মাঝে দুর্নীতি তৈরী করবে না, মানে টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের ত্রিভুজ পাওয়ার সুযোগ করে দিবে না, তার গ্যারান্টি আমরা কিভাবে পাবো?

 ৮. বর্তমান কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বাসা থেকে অ্যাসাইনমেন্ট, গল্প কিংবা কবিতা লিখে আনলেই সৃজনশীলতা তৈরী হয় না। কারণ ঐ শিক্ষার্থী যে ইন্টারনেটে বসে চ্যাটজিপিটি দিয়ে অ্যাসাইমেন্ট, গল্প-কবিতা লিখে আনবে না তার নিশ্চয়তা কি? শিক্ষকরা দেখে তো বলবে, “বাপরে বাপ কত ক্রিয়েটিভ বাচ্চা !” কিন্তু বাচ্চা যে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে গল্প-কবিতা-অ্যাসাইনমেন্ট লিখছে, তা ধরার যোগ্যতা কি স্কুল শিক্ষকদের আছে? শিক্ষকরা মনে করবে শিক্ষার্থীরা এ পাঠ্যক্রমে সৃজনশীল হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাবে, এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আরো মেশিন নির্ভর ও কৃত্তিম হয়ে উঠবে।

Comments