কে ছিলেন ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম রহমতুল্লাহি আলাইহি?

কে ছিলেন ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম রহমতুল্লাহি আলাইহি?

হামাসের স্বশস্ত্র শাখা- ইজ্জুদ্দীন আল-কাসসাম ব্রিগেড :

কে ছিলেন ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম রহমতুল্লাহি আলাইহি?

 লেখা : মুহম্মদ গোলাম সামদানী

 

হাইফার নিকটে ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম রহমতুল্লাহি আলাইহির মাজার শরীফ

 বর্তমানে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত হামাসের নাম অনেকের জানা। তবে হামাস নামক সংগঠনটি কিন্তু সরাসরি যুদ্ধ করে না, যুদ্ধ করে হামাসের স্বশস্ত্র শাখা ‘ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম ব্রিগেড’ নামক একটি যোদ্ধা বাহিনী। ‘ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম ব্রিগেড’ এর নামকরণ করা হয়েছে হযরত ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম রহমতুল্লাহির নাম অনুসারে। উনার আদর্শেই এই যোদ্ধাবাহিনী পরিচালিত হয়। এছাড়া ‘আল কাসসাম ব্রিগেড’ প্রায় ইসরাইলে এক ধরনের রকেট হামলা চালায়, সেই রকেটের নামও উনার অনুসরণে হয় ‘কাসসাম রকেট’ নামে।

 

হযরত ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম রহমতুল্লাহি আলাইহি শহীদ হোন ১৯৩৫ সালে। উনার শাহাদাতের প্রায় ৫৮ বছর পর হামাসের আল-কাসসাম ব্রিগেডের জন্ম। কিন্তু তিনি এমন কে ছিলেন, যে উনার শাহাদাতের এত বছর পরও উনার আদর্শে আল কাসসাম ব্রিগেড সাহসিকতার সাথে ইহুদীবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে ?

 

মূলতঃ ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একজন সিরিয়ান সূফী, কাদেরীয়া ত্বরীকার পীর সাহেব। উনার জন্ম ১৮৮১ বা ১৮৮২ সালে। উনার বাবা ও দাদাও কাদেরিয়া তরিকার পীর সাহেব ছিলেন। এছাড়াও তিনি আফ্রিকা মহাদেশে বহুল প্রচলিত তীজানিয়া ত্বরীকার খিলাফত লাভ করেন। তিনি হানাফি মাহযাবের অনুসারী ছিলেন।

 

ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম রহমতুল্লাহি আলাইহি সাধারণ মানুষকে তরিকতের মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধকরণে নসিহত করতেন। এবং অন্তর পরিশুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে জাগরণ তৈরী করতে চাইতেন। মুসলমানদের মধ্যে মদ ও জুয়ার প্রচলন বন্ধ করে নিয়মিত নামাজ ও রোজা পালন করানো ছিলো উনার কার্যক্রমের অংশ বিশেষ। উনার এই কার্যক্রম সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং সবাই উনাকে সাদরে গ্রহণ করে। তিনি উসমানীয় পুলিশকে শরিয়া আইন প্রয়োগের আহ্বান জানাতেন এবং কখনো কখনো মুরিদদেরকে মদ পরিবহনকারী বাহন রোধ করার জন্য পাঠাতেন।

 

ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম রহমতুল্লাহি আলাইহি ঈদে মিলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাহফিল জারি করতেন এবং নিজে সেই মাহফিলে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি সাধারণ মানুষের সাথে ব্যাপক সংযোগ রাখতেন। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন ও সমস্যার সমাধান দিতেন। তিনি একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু সাধারন মানুষের সাথে কথা বলার কারণে তিনি মাদ্রাসায় সময় মত উপস্থিত হতে পারতেন না বিধায় মাদ্রাসার শিক্ষকতা ছেড়ে দেন।

 

১৯১১ সালে ইতালি লিবিয়ায় আগ্রাসন চালায়, তখন উসমানীয়-লিবিয়ান এক হয়ে ইতালির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তিনি তখন যুদ্ধের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেন। তিনি জুমুয়ার খুতবায় সাধারণ মানুষকে ইতালির বিরুদ্ধে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে বলতেন। সে সময় তিনি জিহাদের জন্য কাসিদা রচনা করেন।

 

يا رحيم، يا رحمن

 أنصر مولانا السلطان

 واكسر أعدانا الايطاليان

 

হে দয়ালু, হে পরম করুণাময়

আমাদের অভিভাবক সুলতানকে বিজয়ী করুন

এবং ইতালীয় শত্রুদের পরাজিত করুন

 

[উল্লেখ্য আখেরী নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রশংসা সূচক কবিতা তথা নাত শরীফ এবং সূফীদের নাশীদ তথা সামা পাঠ করা সম্পর্কে উনার মতামত হলো নিশ্চয় তা শ্রবণকারীদের জন্য ইতিবাচক। কেননা তাদের উদ্দেশ্য ছিল নেককারদের পথ অনুসরণ করা এবং অনুকরণ করা।]

 

পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইজ্জুদ্দীন আল-কাসসাম রহমতুল্লাহি উসমানীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং যুদ্ধের প্রশিক্ষণ লাভ করেন। দামেস্কের নিকটে একটি ঘাঁটিতে তিনি হামলাও চালিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি লিবিয়া চলে আসেন এবং সেখানে ফরাসী দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাহিনী গঠন করেন। তিনি ফরাসিদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করেন।

 

পরবর্তীতে ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম রহমতুল্লাহি ফিলিস্তিনের হাইফায় হিজরত করেন। তিনি সেখানকার শ্রমিকদের পতিতালয় ও নেশা আড্ডা থেকে ধরে এনে তালিমের ব্যবস্থা করেন। তিনি কৃষক ও উব্ধাস্তুদের হেদায়েতের জন্য কাজ করতেন। তিনি খুব ভালো ওয়াজ নসিহত করতে পারতেন এবং সবাইকে কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে উব্দুদ্ধ করতেন। তিনি গ্রামবাসীকে ওয়াজ নসিহতের মাধ্যমে ব্রিটিশ ও ইহুদিদের প্রতিরোধ করতে উৎসাহিত করেন। সে সময় সাধারণ ফিলিস্তিনি নেতারা ইহুদী বসতিস্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু ইজ্জুদ্দীন আল-কাসসাম রহমতুল্লাহি উভয়ের বিরুদ্ধে জিহাদকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। সে সময় অধিকাংশ ফিলিস্তিনি নেতা সেক্যুলারিজম ও জাতীয়তাবাদের সমর্থক হলেও ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম রহমতুল্লাহি আলাইহি ফিলিস্তিনের সংগ্রামকে দ্বীনি জিহাদ হিসেবে দেখতেন। ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসন এবং ইহুদী জায়নবাদিদের উৎখাতের জন্য আল-কাসসাম রহমতুল্লাহি আলাইহি অন্তরপরিশুদ্ধিকরণ ও সামরিক জিহাদ করতে বলতেন।

 

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ইজ্জুদ্দীন আল-কাসসাম রহমতুল্লাহি ২০০ থেকে ৮০০ এর মত যোদ্ধা সদস্য সংগ্রহ করেন এবং তাদের পাঁচজনের একেকটি সেলে বিভক্ত করে সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সেলগুলো বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা সজ্জিত থাকত। ইহুদি বসতিতে ও ব্রিটিশদের নির্মিত রেললাইনে আক্রমণের জন্য এসব অস্ত্র ব্যবহার হত।

 

যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের সময় ইজ্জুদ্দীন আল-কাসসাম রহমতুল্লাহি উন্নত চরিত্রের উপর জোর দিতেন। তাদেরকে অসহায়, অসুস্থদের সেবা, পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা এবং নিয়মিত নামাজ পড়তে বলতেন। শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সাহসী যোদ্ধা হতে এসকল গুণের প্রয়োজন বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি বিয়েকে তরুণদের নৈতিক অধঃপতন বন্ধের উপায় হিসেবে দেখতেন। অনেক সহায়হীন সমর্থকদের বিয়েতে তিনি খরচ জুগিয়েছেন। জিহাদের প্রতি আত্মোৎসর্গের প্রতীক হিসেবে তিনি পুরুষদের দাড়ি রাখা ও সবসময় সঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। তার অনেক অণুসারী নিরক্ষর হওয়ায় তিনি কুরআন শরীফ উনার সাহায্যে তাদের পড়তে ও লিখতে শিখিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি তার যোদ্ধাদেরকে কাদেরিয়া তরিকার বিভিন্ন সবক দিতেন।

 

ইজ্জুদ্দীন আল-কাসসাম রহমতুল্লাহি ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এক জিহাদে মাত্র ৫২ বছর বয়সে শাহাদাত বরণ করেন। হাইফার নিকটে উনার মাজার শরীফ অবস্থিত। তবে আল-কাসসাম রহমতুল্লাহি শহীদ হলেও উনার কারণে ফিলিস্তিনের মানুষ ইহুদীদের বিরুদ্ধে জিহাদে অনুপ্রাণিত হয়। উনার জানাজায় হাজারো মানুষ উপস্থিত হয়েছিল যা সে সময় মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রদর্শনে রূপ লাভ করে। উনার শাহাদাতের স্থান থেকে অনেক মুক্তি সংগ্রামের সূচনা হয়। ইজ্জুদ্দীন আল-কাসসাম রহমতুল্লাহি এমন এক প্রজন্মের সূচনা করেন, যারা কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে বদ্ধ পরিকর। সেই প্রজন্ম থেকে পরবর্তীতে তৈরী হয় হামাসের যোদ্ধা শাখা ‘ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম বিগ্রেড।

Comments