ফিলিস্তিনে সংঘাতের মূল কারণ: ইহুদীদের নিশানাতে ভূমি নাকি আল আকসা শরীফ?

Comments · 1122 Views

ফিলিস্তিনে সংঘাতের মূল কারণ:

ইহুদীদের নিশানাতে ভূমি নাকি আল আকসা শরীফ?

ফিলিস্তিনে সংঘাতের মূল কারণ:

ইহুদীদের নিশানাতে ভূমি নাকি আল আকসা শরীফ?

লেখা: ইনজামামুল রাব্বি

 

বর্তমানে গোটা ফিলিস্তিনে ইজরাইলি দখলদারদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণ সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত। ফিলিস্তিনের এই সংগ্রাম গোটা দুনিয়াব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ডানপন্থী থেকে বামপন্থী, শিয়া থেকে সুন্নী সবাই ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলছে এবং লেখালেখি করছে। কিন্তু এদের বেশিরভাগ লেখা পড়লেই মনে হয় যে ফিলিস্তিনের পক্ষে আন্দোলনটা বুঝি নিছক ভূমি দখলের আন্দোলন এবং মানুষের জীবনের জন্য। কিন্তু আসলে বিষয়টা তেমন নয়। ফিলিস্তিনের জন্য এই সংগ্রামটা জান ও মালের ঊর্ধ্বে। এই সংগ্রামটা হচ্ছে পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফ বিশেষ করে আল আকসা শরীফের জন্য।

আমরা যেমনটা জানি, ফিলিস্তিনকে যে সমস্ত ইহুদী দখল করে রেখেছে তারা কেউ ফিলিস্তিনের আদিবাসী নয়। তারা এসেছে ইউরোপ, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে।

পৃথিবীজুড়ে যখনই কোন একটি জাতিসত্তার মানুষ পৃথক রাষ্ট্র চায় তখন তারা তাদের অবস্থানরত দেশের একটি অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন দেশ হিসেবে কায়েম করতে চায়। কিন্তু ইউরোপের ইহুদীদের ক্ষেত্রে আমরা এই বিষয়টা লক্ষ্য করতে পারি না। তাহলে কেন এই ইহুদিরা হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত একটি দেশকে নিজের দেশ হিসেবে দাবি করে বসলো?

কারণটা জানার জন্য আমাদের ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে, কারণ তারা এই ধর্মের দোহাই দিয়েই ফিলিস্তিন দখল করে রেখেছে। হিব্রু বাইবেল অথবা তানাখ যেটাকে বিকৃত তাওরাত শরীফ বলা হয়, সেই বই পড়লে আমরা বিভিন্ন সময় একটি শব্দের সন্ধান পাব শব্দটা হল জায়ন (Zion)। হ্যাঁ এই শব্দ থেকেই জায়নবাদ (Zionism) এর উৎপত্তি। তানাখ বিশেষজ্ঞদের মতে জায়ন বলতে একই সাথে জেরুজালেম এবং গোটা ফিলিস্তিনকেই বোঝানো হয়েছে। ঠিক যেভাবে ইসলামিক পরিভাষায় বায়তুল মুকাদ্দাস শরীফ বলতে ক্ষেত্র বিশেষে আল আকসা মসজিদ কমপ্লেক্স, আল কুদস শহর এবং আশেপাশের দেশ বা অঞ্চলকে বোঝানো হয়ে।

তানাখে জেরুজালেম শহরকে জায়ন বলার পিছনে ধর্মীয় তাৎপর্য রয়েছে। মূলত জায়ন শহরের তিন মাথায় তিনটি পাহাড় রয়েছে। ইতিহাসবিদগণ বিভিন্ন সময় এই তিন পাহাড়কেই মাউন্ট জায়ন অথবা জায়ন পাহাড় নামে ডেকেছে। কিন্তু ইহুদি তানাহ্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, যে পাহাড়ের উপরে আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্স অবস্থিত সেই পাহাড়টাই হচ্ছে আসল মাউন্ট জায়ন।

তাহলে পাঠক বুঝতেই পারছেন যে, ইহুদি ধর্ম মতে আল আকসা মসজিদ, জেরুজালেম শহর এবং ফিলিস্তিন দেশ সবই এক সুতায় গাঁথা।

তাহলে এখন আমরা ইহুদিদের এই ভূমিতে আগমণের কারণে ফিরে আসি। ইহুদিদের দাবি অনুযায়ী, তানাহক-এ সৃষ্টিকর্তা এই জায়ন অঞ্চলটি ওদের ভূমি হিসেবে ওয়াদা করেছেন। তাই তারা হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ফিলিস্তিন নামক এই দেশকে দখল করার জন্য চলে এসেছে।

এখন আমাদের জানতে হবে যে, তারা এই অঞ্চলটাকে দখল করে কি করতে চায়? তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? এই পরিকল্পনার কথাও তাদের ধর্মীয় বইগুলোতে বলা আছে।

এই পরিকল্পনা বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে, যে ভূমির উপরে আল আকসা মসজিদ অবস্থিত সেই ভূমি ইহুদি ধর্মে তাৎপর্যটা আসলে কেমন। শহরায়নের কারণে বুঝা না গেলেও আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্স একটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত, সেই পাহাড়টাকে তারা মাউন্ট জায়ন অথবা টেম্পেল মাউন্ট বলে থাকে। টেম্পেল মাউন্ট বলার পিছে আসল কারণটা হচ্ছে যে, এই পাহাড়ের উপরেই নবী হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম ইহুদি ধর্ম মতে তার মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। সেই মসজিদটাকে ইহুদীরা তাদের ভাষায় টেম্পল বলে এবং এই টেম্পলে তারা এক খোদার উপাসনা করে থাকে। কিন্তু ব্যাবিলনের সাথে যুদ্ধে এক পর্যায়ে সেই টেম্পলটি ভাঙ্গা পড়ে। সেই প্রথম টেম্পেলের পশ্চিম পাশে শুধু একটি দেওয়াল অবশিষ্ট রয়েছে এখন, আপনারা দেখে থাকবেন যে, যেই দেয়ালটাতে ইহুদিরা মাথা ঠেকায় সেই দেওয়ালটাই হচ্ছে ওই প্রথম টেম্পেলের পশ্চিম দেয়াল।

পরবর্তীতে এক ইহুদি রাজা সেই টেম্পেল মাউন্ট এর উপর আরেকটি দ্বিতীয় টেম্পল নির্মাণ করে, কিন্তু সেই দ্বিতীয় টেম্পলটাও রোমান সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধে ভাঙ্গা পড়ে। অতঃপর সেখানে খোলাফায়ে রাশেদীন ওনাদের আমলে এই অঞ্চলটি খেলাফতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। তখনই সেই পাহাড়ে মসজিদ নির্মাণ করা হয় এবং একই সাথে সেই মসজিদ কমপ্লেক্সে বর্তমানে ছয়টা পৃথক মসজিদ অবস্থিত। এই মসজিদগুলোকেই আমরা একসাথে আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্স হিসেবে জানি।

ইহুদি ধর্ম অনুযায়ী এই টেম্পল মাউন্টটাই হচ্ছে ওদের প্রধান কিবলা, ওদের ধর্ম অনুসারে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম বলে গেছেন যে, আল্লাহ পাক একজন আখেরি নবী এবং রসূল প্রেরণ করবেন এবং উনি ইহুদিদেরকে নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন যাতে ওরা সবাই ওনার উম্মত হয়ে যান। বর্তমানে যারা ইহুদি ধর্ম পালন করে তারা সেই আখেরি নবীর জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা এটাও বিশ্বাস করে যে আখেরি নবী এসে সেই টেম্পেল মাউন্ট এর উপরে ওদের জন্য নতুন করে কেবলা নির্মাণ করে দিবে।

বর্তমান সময়ে দখলদার ইহুদিদের মধ্যে প্রধাণত দুইটা ভিন্ন মত দেখা যায়। একটি মত অনুযায়ী, যেহেতু আখেরি নবী আসছেন সেহেতু তাদেরকে আগেভাগেই টেম্পেল মাউন্ট এ অবস্থিত মসজিদগুলোকে ধ্বংস করে তথা শহীদ করে তার উপরে তৃতীয় টেম্পল নির্মাণ করে ফেলা উচিত। তাদের বিপরীত ইহুদিরা সেখানে তৃতীয় টেম্পল নির্মাণের বিরুদ্ধে থাকলেও মসজিদ শহীদ করার ব্যাপারে তারা সবাই একমত। এর জন্যই প্রায়ই দেখা যায় যে আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সে ইহুদিরা হামলা করছে এবং সেটার দখল তারা ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে।

কিন্তু এই বিভ্রান্ত ইহুদিরা বিশ্বাস করতে চায় না যে, যেই আখেরি নবীর জন্য তারা অপেক্ষা করছেন উনি হচ্ছেন আমাদের নবীদের নবী রসূলদের রসূল নূরে মুজাসসাম হাবিবুল্লাহ হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি। তিনি ইতিমধ্যেই পৃথিবীতে আগমণ করেছেন এবং আল্লাহ পাকের নির্দেশে বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফ থেকে কিবলা ঘুরিয়ে মক্কা শরীফে স্থানান্তর করেছেন। এবং ওনার মোবারক হাত ধরে যে সকল বনি ইসরাইলিদের হেদায়েত লাভ করার কথা ছিল তারা হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছেন।

অতঃপর আমরা জানতে পারলাম যে এতদিন আমাদের সামনে যে সকল বয়ান হাজির করা হয়েছিল যে, পৃথিবীজুড়ে ইহুদিরা নির্যাতিত তাই তাদের জন্য ফিলিস্তিনে একটা পৃথক ভূমি দরকার যেখানে তারা নিরাপদে থাকতে পারবে। সেটা আসলে সত্য নয় ফিলিস্তিন দখল করার তাদের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে ধর্মীয়। তারা তাদের বিভ্রান্ত এবং বিকৃত ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এবং এই উদ্দেশ্য তখনই সফল হবে যখন তারা আল-আকসা মসজিদকে শহীদ করতে পারবে।

 

Comments