বাংলায় অনন্য এক ইসলামিক স্থাপত্য আদিনা মসজিদ

Comments · 3909 Views

আদিনা মসজিদ পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার হযরত পান্ডুয়া বা ফিরুজাবাদে অবস্থিত এক ইসলামিক স্থাপত্য।

চিত্র ঐতিহাসিক আদিনা মসজিদ

চিত্র:ঐতিহাসিক আদিনা মসজিদ

আদিনা মসজিদ পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার হযরত পান্ডুয়া বা ফিরুজাবাদে অবস্থিত এক ইসলামিক স্থাপত্য। এটি কেবল বাংলায়ই নয়, গোটা উপমহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম মসজিদ। মসজিদের পেছনের দেয়ালে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি অনুসারে জানা যায় মসজিদটি ১৩৭৩ খৃ: ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দর শাহ নির্মান করেন। সুলতানের ইচ্ছা ছিল দামেস্ক, বাগদাদ, কর্ডোভা অথবা কায়রোর ওই সকল রাজধানী শহরের মসজিদগুলির আকার ও আড়ম্বরের সঙ্গে তুলনীয় ভারত উপমহাদেশে একটি মসজিদই নির্মাণ করবেন। সেই ইচ্ছার বাস্তবায়নেই নিমার্ণ করা হয় আদিনা মসজিদ, শুধু আকার—আয়তনেই আদিনা মসজিদ ওই নগরীসমূহের মসজিদগুলির সঙ্গে তুলনীয় নয়, নকশা ও গুণগত দিকেও এটি বিশ্বের সেরা মসজিদগুলির প্রথম সারিতে। মসজিদের তিনদিকে খিলান দ্বারা আচ্ছাদিত পথ এবং কিবলামুখী বিশাল নামাজ কক্ষের মাঝখানে উন্মুক্ত প্রাঙ্গন। উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলির কারণেই আদিনা বলা যায় যে আদিনা মসজিদে কোন কিছুর কমতি পাওয়া যায় না। 

 

ভূমি নকশা, আদিনা মসজিদঃ

মসজিদটির দেয়ালগুলির নিচের অংশ পাথর বাঁধানো ইট ও অন্য অংশগুলি শুধু পোড়া ইট দিয়ে তৈরী। মসজিদের আয়তন এখনও যথার্থভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি, তবে কোণের পলকাটা স্তম্ভসমূহসহ বাইরের দিকে প্রায় ১৫৫ মি দ্ধ ৮৭ মি এবং ভেতরের দিকে খিলান আচ্ছাদিত পথসহ ১২২ মি দ্ধ ৪৬ মি. বলে ধারণা করা হয়। উন্মুক্ত প্রাঙ্গনের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বদিকে ১২ মিটার প্রশস্ত খিলানপথে তিনটি ‘লাইন’ এবং ২৪ মিটার প্রশস্ত নামাজকক্ষে পাঁচটি ‘লাইন’ আছে, নামাজ কক্ষের মাঝামাঝি একটি প্রশস্ত খিলানছাদ অবস্থিত।

চিত্র:বর্তমানে আদিনা মসজিদের ঐতিহাসিক ভূমি।

মাঝামাঝি এই খিলানের আয়তন ২১১০ মিটার এবং উচ্চতা প্রায় ১৮ মিটার, বর্তমানে খিলানটি পতিত অবস্থায় রয়েছে। মসজিদের গম্বুজের সংখ্যা ৩০৬ থেকে ৩৭০টি বলে জানা যায়। আবার কারো মতানুসারে, গম্বুজের সংখ্যা ২৬০। স্তম্ভগুলি ভিত্তিমূলে বর্গাকার, মধ্যস্থলে গোলাকার এবং উপরে শীর্ষস্থানের দিকে বাঁকা। নামাজ কক্ষের উত্তরে খিলান দ্বারা আচ্ছাদিত পথের উপরের কয়েকটি ছাড়া গম্বুজগুলি ত্রিকোণবিশিষ্ট পেন্ডেন্টিভের উপর স্থাপিত। বর্তমানে পতিত গম্বুজগুলি উল্টানো পানপাত্র আকারের ছিল যা সুলতানি আমলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। পার্শ্বস্থ অবলম্বনসমূহ ও কার্নিশসহ খিলান আচ্ছাদিত। পথের খিলানগুলির নকশা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, খিলান—ছাদে একটি দ্বারপথ ছিল যা নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকে সম্মুখভাগের নকশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো, এবং সে সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্য অব্যাহত রাখতে উপরে একটি উন্মুক্ত খিলান ব্যবহার করা হয়েছিল ।

চিত্র:আদিনা মসজিদের অভ্যন্তরভাগ।

মসজিদের বিবরণঃ

আদিনা মসজিদের মতো প্রাচীন বাংলায় এ ধরনের মসজিদ দ্বিতীয়টি নির্মিত হয়নি। এটি প্রাচীন বাংলার সর্ববৃহৎ মসজিদ এবং অবিভক্ত ভারতে নির্মিত অন্যতম বৃহৎ মসজিদ। এটিকে বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর স্থাপনা বলে মনে করা হত।

 

এ মসজিদটি ফুস্তাত মসজিদ, দামেশক মসজিদ, সামাররা মসজিদ, আবু দুলাফ মসজিদ ও ইবনে তুলুন মসজিদের নকশার অনুকরণে নির্মিত হয়। এ নকশার মসজিদ প্রাচীন বাংলায় দ্বিতীয়টি নির্মিত হয়নি। প্রাচীন বাংলার মসজিদগুলো সাধারণত আচ্ছাদনযুক্ত। এ মসজিদের জেনানা গ্যালারির নিচে কয়েকটি বিশাল আকারের স্তম্ভ রয়েছে। এরূপ স্তম্ভ হুগলি জেলার জাফর খান গাজীর মসজিদ, মালদা জেলার গৌড়ের গুনমন্ত মসজিদ, কদম রসূল ইমারত এবং বাংলাদেশের দারাসবাড়ি মসজিদে দেখা যায়। এ মসজিদের কিবলা দেওয়ালে দুটি প্রবেশপথ রয়েছে। একটি কিবলা দেওয়ালের পার্শ্বে ও অন্যটি জেনানা গ্যালারির নিচে। বাগেরহাটের ষাট গুম্বুজ মসজিদের কিবলা দেওয়ালের মধ্যেও অনুরূপ একটি প্রবেশপথ আছে। ঝিনাইদহ জেলার বারবাজারের সাতগাছিয়ায় মসজিদের কিবলা দেওয়ালেও অনুরূপ একটি প্রবেশপথ ছিল। এটি পরবর্তী সময়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। মসজিদের কিবলা দেওয়ালে এরূপ প্রবেশপথ ভারত, কুফা, বসরা ও মিশরে দেখা যায়। আদিনা মসজিদের নামাজ কক্ষের পূর্বদিকে একটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ বা সাহান রয়েছে। এ প্রাঙ্গণের তিন দিকে রিওয়াক রয়েছে।

 

চিত্র:আদিনা মসজিদের অভ্যন্তরভাগে গম্বুজের নিচের অংশ।

এ সাহানের মধ্যে একটি কুপ ছিল। কুপের পানি দিয়ে মুছল্লিরা ওজু করতেন। বিশাল একটি মসজিদের মধ্যে নামাজিদের ওযুর জন্য একটি ছোট কুপ যথেষ্ট ছিল বলে মনে হয় না। ধারণা করা হয় ওজু করার জন্য অন্য কোন ব্যবস্থা ছিলো। বর্তমানে এ কুপটি বন্ধ করে সেখানে একটি পাতাবাহারের গাছ লাগানো হয়েছে।

 

এ মসজিদের উত্তর—পশ্চিম কোণে সূফী ব্যক্তিবর্গ যারা ছিলেন উনাদের নির্জন ইবাদত এবং পবিত্র রমাদ্বান শরীফ উনার শেষ ১০ দিনের ইতেকাফের জন্যও একটি যায়গা ছিল ।

 

এ মসজিদের সিঁড়িযুক্ত মিম্বরটি হুগলি জেলার ছোট পান্ডুয়ার বড়ি মসজিদের মিম্বারের অনুরূপ। পার্শ্ববর্তী কুতুবশাহি মসজিদের অনুরূপ মিম্বর দেখা যায়।

 

গুজরাটের একটি মসজিদের নামও আদিনা মসজিদ। বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার বারবাজারের সাতগাছিয়া এলাকার মসজিদটিও আদিনা মসজিদ নামে পরিচিত। বাগেরহাটের একটি প্রত্নস্থলের নাম বড় আজিনা মসজিদ। আজিনা শব্দটি আদিনা শব্দের অপভ্রংশ হতে পারে। আদিনা অর্থ জুমুয়াবার।

 

চিত্র:বর্তমানে আদিনা মসজিদের সম্মুখভাগের নান্দনিক সৌন্দর্য।

এ মসজিদের জেনানা গ্যালারির দোতলায় তিনটি মিহরাব রয়েছে। মিহরাবগুলোর মধ্যে পবিত্র কলেমায়ে শাহাদাত শরীফ, পবিত্র আয়াতুল কুরসি সূরার ২৫৫ তম আয়াত শরীফ এবং পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার অন্যান্য আয়াত শরীফও ক্যালিগ্রাফি করা রয়েছে। ক্যালিগ্রাফিগুলো কুফিক লিপি ও নসখি লিপির সংমিশ্রণে লিখা হয়েছে।

 

মসজিদের বহির্দেশে জেনানা গ্যালারির পশ্চিমে একটি প্লাটফর্ম রয়েছে। এ অংশটি অতিতে ৯ গুম্বুজ বিশিষ্ট ছিল। বর্তমানে চারটি পিলার থাকলেও কোনো গুম্বুজ নেই। আদিনা মসজিদের এ প্লাটফর্মযুক্ত অংশকে অনেকে বাংলার ৯ গুম্বুজ মসজিদের পূর্বরূপও বলেছেন।

 

আদিনা মসজিদের কিবলা দেয়ালের বাহিরের দেয়ালে অন্তঃপ্রবিষ্ট পিলার দেখা যায়। এ ধরনের পিলার হুগলি জেলার বড়ি মসজিদে সর্বপ্রথম দেখা যায়। পরবর্তীকালে নির্মিত মসজিদগুলোর কোণার বুরুজ বা পিলারগুলোকে বাংলার স্থানীয় উপকরণ বলা হয়েছে।

 

চিত্র: আদিনা মসজিদের গায়ে নান্দনিক কারুকার্য। মুসলমানদের এই শল্পকর্মটি  বিশ্বে অ্যারোবেক্স শিল্পকর্ম হিসেবে পরিচিত।

মসজিদের অলংকরণঃ

কালের চাপ উপেক্ষা করে খিলান ছাদযুক্ত প্রবেশদ্বারসহ পশ্চিম দেয়ালের অংশবিশেষ মাত্র টিকে আছে। মসজিদটির অলঙ্করণ সম্পর্কিত বিষয়াবলি, স্তম্ভসমূহের কাঠামোগত নকশা, পেন্ডেন্টিভ, মিহরাব, সম্মুখ ভাগের টেরাকোটা, টালির অলঙ্করণ এবং হস্তলেখা শিল্পসমৃদ্ধ শিলালিপী সমূহের ভাঙ্গা শেষ অংশ এখনও পরিষ্কার ভাবেই দেখা যায়। খিলানের উপরিভাগের অন্যান্য লেখা অলংকরণসমূহের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় উদ্ভিজ নকশা, গোলাপ সদৃশ ফুলের নকশা, বিমূর্ত ‘অ্যারাবেক্স’ নকশা, জ্যামিতিক নকশা, বর্ণনাতীত জটিল নকশাসমূহ। তবে এই মসজিদের সমস্থ কিছুই আকর্ষণীয় করে তৈরী করা হয়েছে। এই মসজিদ নির্মানের ক্ষেত্রে পুরো সৃজনশীলতাই দেখানো হয়েছে। মসজিদ অলংকরণের ক্ষেত্রে কাঠামোগত এবং বহির্ভাগ, উভয় দিক হতেই, আদিনা মসজিদ একটি উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করেছে, এই মসজিদের নকশা থেকেই পরবর্তীকালে সুলতানি আমলের বাংলার স্থাপত্যশিল্পে বেশ কিছু অনন্য সাধারণ ইমারত নির্মিত হয়েছে।

 

সূত্র:al-ihsan.net

 

Comments
Muhammad Ibrahim Sohel 2 yrs

মাশাআল্লাহ, এরকম ব্লগ পোষ্ট নিয়মিত চাই।