মুসলমানের আত্মকেন্দ্রীকতা, অস্তিত্বের সংকট, আত্ম-পরিচয় অনুভব
বর্তমান মুসলমানদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রীক থাকার প্রবণতা খুব বেড়েছে। সমষ্টিগত চিন্তাভাবনা কেউ করতে চায় না, একত্রিত বা জোটবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা নেই বললেই চলে। অধিকাংশ মুসলমানের মধ্যে একলা চলো নীতি বিদ্যমান। ‘আমি একা ভালো থাকলেই হলো’ এমন মানসিকতা সমাজে দেখা যাচ্ছে বেশি। তবে শঙ্কার বিষয় হলো, আমাদের মুসলিম সমাজে ভালো মানুষগুলো একলা চলতে পছন্দ করে অথচ সমাজের চিহ্নিত খারাপ মানুষগুলো একজোট বা সিন্ডিকেট হয়ে বসবাস করে। এ আর একজোট থাকার কারণে সমাজে খারাপ মানুষগুলো প্রভাব বিস্তার করে, অপরদিকে ভালো মানুষগুলো বিচ্ছিন্ন থাকায় সমাজে কোন প্রভাব থাকে না। যদিও সমাজে ভালো মানুষের সংখ্যা বেশি, খারাপ মানুষের সংখ্যা নগণ্য।
দেখা যায়, খারাপ মানুষগুলো তার খারাপ স্বভাব সমাজে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায়, কিন্তু ভালো মানুষগুলো তার ভালো স্বভাব সবার মধ্য ছড়িয়ে দিতে চায় না, নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেই সন্তুষ্ট। অথচ সমাজে ছড়িয়ে পড়া খারাপ বিষয়গুলো তাকে স্পর্শ না করলেও তার পরবর্তী প্রজন্মকে যে স্পর্শ করবে না, সেটা কিন্তু সে নিশ্চিত বলতে পারে না।
আবার ভালো মানুষ ভালো বিষয় অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার অভ্যাস না থাকায়, সে নিজের সন্তানকেও সেই বিষয় শিক্ষা দিতে পারে না। আর খারাপ মানুষ খারাপ বিষয় ছড়িয়ে দিতে দিতে এমন অভ্যাস তৈরী হয় যে, নিজের সন্তান তো অবশ্যই ভালো মানুষের সন্তানরাও তাদের ক্ষপ্পরে পরে যায়। ভালো মানুষদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, শুধু খাওয়ার যোগান দেয়া সন্তানের একমাত্র প্রয়োজন না, পশু-পাখিও সন্তানকে খাওয়া দেয়। কিন্তু পশু-পাখি ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য মন-মননের শিক্ষা। একজন ভালো মানুষকে নিজ সন্তানদেরকে খাওয়া-পরার পাশাপাশি সেই মন-মননের শিক্ষা দেয়ারও চিন্তা রাখতে হবে। সন্তানকে আদর্শিক দিতে হবে।
‘আপনি কেন সামষ্টিক চিন্তাভাবনা লালন করেন না, কেন জোটবদ্ধ হতে চান না?’- এই কথা বললেই কেউ কেউ বলে, “ভাই সামষ্টিক কিছু করতে গেলে সময় দিতে হয়, সেই সময় কোথায়? কামাই রোজগার করতে করতে দিন শেষ। ” কথা সত্য, কিন্তু আংশিক। যে খারাপ মানুষদের কথা বললাম, তারাও কিন্তু কামাই রোজগার করে, এবং জোটবদ্ধ হওয়ার জন্য আলাদা সময় দেয়। তারা যদি জোটবদ্ধ হতে সময় দিতে পারে, তবে ভালো মানুষগুলোর সময় দিতে কমতি হয় কেন?
আসলে মানুষ জোটবদ্ধ হয় অস্তিত্বের সংকটের কারণে। যখন কেউ বুঝে তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে, তখন সে টিকে থাকার জন্য জোটবদ্ধ হয়। বনের পশুরা যেমন চিন্তা করে, জোটবদ্ধ না থাকলে অন্য পশুর শিকারে পরিণত হতে হবে, ঠিক তেমন। তার অস্তিত্বের সংকট তাকে জোটবদ্ধ করে ফেলে। সমাজে খারাপ মানুষগুলো জানে, সমাজে খারাপ কাজ করতে গেলে বাধা আসতে পারে, তখন সে অস্তিত্বের সংকটে পড়বে, তাই সমাজে টিকে থাকতে সে আরো খারাপ মানুষের সাথে জোটবদ্ধ হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে সেই চিন্তা নাই। সে ভাবে, “আমার আবার শত্রু কে?” অস্তিত্বের সংকট সে অনুভব করে না। তার আচরণ হয় একটা শিশুর মত। শিশু যেমন মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়, তার কোন চিন্তা নাই, পেরেশানি নাই, কারণ সে জানেই না তার শত্রু কে, কিংবা তার অস্তিত্বের কোন সংকট আছে কি নেই।
একজন মুসলমানের ক্ষেত্রে অস্তিত্বের সংকটের চিন্তা তখন আসবে, যখন একজন মুসলমান নিজেকে মুসলমান হিসেবে আত্ম পরিচয় অনুভব করবে। নিজেকে মুসলমান হিসেবে অনুভব করার পর যখন সে দেখবে, সমাজে তার মুসলিম পরিচয় বা ঈমান-আকিদ্বা ও আমলে আঘাত আসছে, তখন সে অস্তিত্বের সংকট অনুভব করবে। তখন সেই সংকট থেকে বাচতে সে সংঘবদ্ধ বা জোটবদ্ধ হবে, সমষ্টিগত চিন্তা করবে।
সমস্যা হচ্ছে, বর্তমান মুসলিম সমাজ নিজেদের মুসলমান হিসেবে আত্মপরিচয় অনুভবই করে না বা গুরুত্ব দেয় না। বরং নিজেকে সুশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, অমুক দলের সমর্থক, তমুক এলাকাবাসী, তমুক পেশার প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ফলে ঐ পরিচয়গুলোতে যখন আঘাত আসে, তখন সে ঐ পরিচয় থেকে অস্তিত্বের সংকট অনুভব করে। কিন্তু মুসলমান আত্মপরিচয়ে যখন আঘাত আসে, তখন অস্তিত্বের সংকট অনুভবই করে না, কারণ তার মুসলিম হিসেবে আত্মপরিচয়বোধই নেই।
এজন্য একজন মুসলমান যখন মুসলিম হিসেবে আত্মপরিচয়বোধ অনুভব করবে, ঐ পরিচয়ে যখন আঘাত আসবে, তখন সে অস্তিত্বের সংকট অনুভব করবে, আর সেই অস্তিত্বের সংকট থেকে সে দলবদ্ধ বা সমষ্টিবদ্ধ হয়ে সেই আঘাত প্রতিহত করতে যাবে, কারণ একা একা তার পক্ষে সেই আঘাত সামাল দেয়া সম্ভব নাও হতে পারে।
এজন্য আসলে আল্লাহ পাক মুসলমানদের জোটবদ্ধ বা একতাবদ্ধ থাকতে বলেছেন। মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ মুবারক করেন- “আর তোমরা সবাই আল্লাহ পাক উনার রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিভক্ত হয়ো না।” (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১০৩)। দ্বীন ইসলামে সমষ্টিবদ্ধতা থাকার গুরুত্ব কতটুকু, এটা ৫ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায়ের তাগিদ দ্বারা অনুধাবন করা যায়। পুরুষকে জামাতে নামাজ পড়তে সর্বোচ্চ তাগিদ দেয়া হয়েছে, একা একা নামাজ পড়তে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তারমানে দিনে ৫ বার মুসলমানরা যদি জোটবদ্ধ হতে পারে, তবে তাদের মধ্যে আলাদা শক্তি, প্রভাব বৃদ্ধি পাবে, যার দ্বারা তারা শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবে।
একটা জিনিস সব সময় মনে রাখবেন, আপনার শত্রু সবসময় চাইবে, নিজে জোটবদ্ধ বা সিন্ডিকেট করে থাকতে, আর আপনাকে জোটহীন বা বিচ্ছিন্ন রাখতে। অর্থাৎ সে যতক্ষণ সিন্ডিকেটের সাথে থাকবে, ততক্ষণ সে ক্ষমতাবান, আর আপনি যতক্ষণ জোটহীন বা একা ততক্ষণ আপনি ক্ষমতাহীন এবং দুর্বল। এ কারণে কাফির-মুশরিকরা মুসলমানদের নানান থিউরী দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি তৈরী করে রাখে। মুসলমানরা যেন এক না হতে পারে সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। ব্রিটিশদের তো একটা পলিসি ছিলো- ডিভাইড এন্ড রুল। অর্থাৎ বিভক্তি করো এবং শাসন করো।
তবে হ্যা, কাফিররা চায় মুসলমানরা এক হোক, তবে সেটা জাতিগত উন্নয়নে নয়। বরং নিজের নফসকে পরিতৃপ্ত করতে। বিনোদন বা এন্টারটেইমেন্টের জন্য। ক্রিকেট খেলা দেখতে ১০ হাজার লোক হয়ে গেছে, কনসার্ট দেখতে ৩০ হাজার লোক এক হয়ে গেছে, অমুক পর্যটন কেন্দ্রে ৫০ হাজার লোক এক হয়ে গেছে, সিনেমা হলে হাজার লোকে ভীড় লেগেছে। অর্থাৎ একত্র হতে পারবে, কিন্তু সেটা নিজের নফসকে আরাম দিতে। কিন্তু নিজেদের জাতিগত উন্নয়নে এক হওয়া নিষেধ।
এ কারণে মুসলমানরা যদি চায়, কাফিরদের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে, তাদের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে, তবে মুসলমানদের অবশ্যই জোটবদ্ধ বা একতাবদ্ধ থাকতে হবে, আত্মকেন্দ্রীক না হয়ে সামষ্টিক চিন্তাভাবনা করতে হবে, তবেই ধরা দিবে সাফল্য।