কুকুরপ্রেমীদের জন্য কুকুর নিধন বন্ধ : বেওয়ারিশ কুকুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সারা দেশ
-ইঞ্জিনিয়ার মুহম্মদ রেজাউল করিম
দেশে এখন রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর নিধন বন্ধ। এতে দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে বেওয়ারিশ কুকুর। এমন কোন অলি, গলি, রাস্তা নেই যেখানে কুকুরের দল নেই। দিন-দুপুরে অনেক রাস্তায় চলাচল করা এখন আতঙ্কের বিষয়। কখন বেওয়ারিশ কুকুর যেন হামলে পরে। গত কিছুদিনে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে-
১. ফেনীর পরশুরামে কুকুরের কামড়ে আহত ২০ (তথ্যসূত্র: আজকের পত্রিকা, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩)
২. মৌলভীবাজারে কুকুরের কামড়ে শিশুসহ আহত ১৫ (তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলা, ২ ডিসেম্বর, ২০২৩)
৩. গোলাপগঞ্জে কুকুরের কামড়ে শিশু ও নারীসহ আহত ১২ (তথ্যসূত্র: জিভয়েস২৪, ১ ডিসেম্বর, ২০২৩)
৪. পাবনায় কুকুরের কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় এক ব্যক্তি নিহত (তথ্যসূত্র: পাবনাটাইমস, ডিসেম্বর ১১, ২০২৩)
তবে কুকুর যে শুধু মানুষের ক্ষতি করে বিষয়টি এমন না, খামারের গরু ছাগল মুরগীসহ অন্যান্য প্রাণীকূলের জন্য ক্ষতিকর এই বেওয়ারিশ কুকুর। সম্প্রতি সেন্টমার্টিনে বেওয়ারিশ কুকুরের আধিক্যের কারণে সেখানে কাছিমের ডিম পারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ কাছিম সেন্টমার্টিন ডিম পাড়তে আসলে বেওয়ারিশ কুকুর সেই ডিমগুলো খেয়ে ফেলে। ফলে কাছিম সেন্টমার্টিন আসা বন্ধ করে দিয়েছে। উল্লেখ্য সেন্টমার্টিনে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। (তথ্যসূত্র: দৈনিক সমকাল, ২৩ জানুয়ারি ২০২২)
বর্তমানে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, বেওয়ারিশ কুকুরের অত্যাচার থেকে বাঁচতে যেন কিছুই করার নেই। কুকুর কামড়ালেই আশঙ্কা থাকে ভয়ঙ্কর র্যাবিস রোগের। সবস্থানে র্যাবিসের ফ্রি ভ্যাকসিনও পাওয়া যায় না। ফলে অতি উচ্চমূল্যের ভ্যাকসিনটি কিনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
উল্লেখ্য সরকারের বেওয়ারিশ কুকুর নিধনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে গত কয়েক বছর যাবত। যার পেছনে কাজ করছে একদল কুকুরপ্রেমী। তারা রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর নিধনের বিপক্ষে। তাদের দাবী, কুকুরেরও বাঁচার অধিকার আছে। সুতরাং রাস্তার কুকুরকে নিধন করা যাবে না।
এক্ষেত্রে কুকুরপ্রেমীরা দাবী করে, বাংলাদেশ প্রাণী কল্যাণ আইন ২০১৯ এ নাকি বেওয়ারিশ কুকুর নিধন নিষিদ্ধ। যদিও তাদের এ দাবী ভুল। বাংলাদেশ প্রাণী কল্যাণ আইন ২০১৯ এ বেওয়ারিশ কুকুর নিধন মোটেও নিষিদ্ধ করা হয়নি, বরং ক্ষেত্র বিশেষে বৈধতা দেয়া আছে। যেমন- আইনের ৭ (১) ধারায় যদিও বলা আছে, ‘এই আইনে উল্লিখিত কোনো কারণ ব্যতীত, মালিকবিহীন কোনো প্রাণি নিধন বা অপসারণ করা যাইবে না।’ কিন্তু এর ৬(৪) ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে: এই ধারার ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, প্রাণির প্রতি নিম্নবর্ণিত আচরণ বা কার্য অপ্রয়োজনীয় নিষ্ঠুর আচরণ হিসাবে গণ্য হইবে না, যদি (খ) নিষ্ঠুরতাটি সৎ উদ্দেশ্যে, যেমন- উক্ত প্রাণি বা অন্য কোনো প্রাণির উপকার অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি বা অন্য কোনো প্রাণির প্রাণ সংশয়ের হুমকি নিরসনের জন্য করা হয়। অর্থাৎ নাগরিকদের ‘প্রাণ সংশয়ের হুমকি নিরসনের জন্য’ অথবা তাদের পোষা বা পালিত প্রাণীর ‘প্রাণ সংশয়ের হুমকি নিরসনের জন্য’ কুকুর নিধনের অধিকার প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯-এ দেয়া হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন-২০০৯ অনুসারে, তৃতীয় তফসিলের ১৫.৩, ১৫.৪, ১৫.৫ ও ১৫.১০ এবং পঞ্চম তাফসিলের ৫১ ধারা ও সপ্তম তফসিলের ১৮ ধারা অনুযায়ী, সিটি কর্পোরেশন কুকুর স্থানান্তর করতে বা এমনকি নিধনও করতে পারে।
আসলে বাংলাদেশে এইসব কুকুরপ্রেমীদের পেছনে কাজ করছে কিছু ওষুধ কোম্পানি ও এনজিও। কারণ কুকুর নিধন বন্ধ থাকলে মানুষকে প্রচুর পরিমাণে কুকুর কামড়াবে, ফলে বাধ্য হয়ে এই অতিমূল্যবান ইনজেকশনটি কিনতে হবে। এছাড়া কুকুরকেও র্যাবিসমুক্ত করতে দেয়া হবে ইনজেকশনটি। ফলে তাদের র্যাবিস ইনজেকশনের ব্যবসা প্রচুর পরিমাণে হবে।
আবার কুকুর নিধন বন্ধ করে কুকুরকে বন্ধাকরণের দাবী তোলে তারা। এতে রাস্তার কুকুরকে বন্ধ্যা করতে সরকারকে মোটা অংকের টাকা বাজেট পাশ করতে হয়। সেই বন্ধ্যাকরণের কাজ পায় কুকুরপ্রেমী এনজিওগুলো। এছাড়া কুকুরের শেল্টার সেন্টারের নামে সরকারের থেকে বিশাল যায়গা বাগিয়ে নেয় তারা। অর্থাৎ কুকুর প্রেমের নাম দিয়ে তারা বিরাট আর্থিক লাভবান হয় এনজিওগুলো।
উল্লেখ্য, পৃথিবীর কোন উন্নত রাষ্ট্রেই বাংলাদেশের মত রাস্তায় এভাবে কুকুর বেওয়ারিশভাবে ঘুরতে দেয়া হয় না। রাস্তায় এভাবে অবাধে বেওয়ারিশ কুকুর ঘুরতে দেয়া শুধু মানুষের জন্য হুমকি নয়, বরং অপরিচ্ছন্নতা ও রোগ-শোকের কারণ। কারো যদি বেশি কুকুর প্রেম হয়, তবে সিটি কর্পোরেশন থেকে অনুমতি নিয়ে নিজ বাসায় কুকুর নিয়ে পালতে পারে। কিন্তু রাস্তায় মানুষের সমস্যা করে কুকুর নিধনে বাধা দিবে, কুকুরে সয়লাব করে ফেলবে এটা তো ঠিক না। নিরাপদে চলাচল করা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কুকুরের আধিক্যের কারণে নাগরিকের সেই অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
আসলে রাস্তার কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ কর্মসূচি, কুকুরকে র্যাবিস ইনজেকশন কিংবা কুকুরের শেল্টার সেন্টার অতি ব্যয়বহুল একটি কার্যক্রম। সরকারকেই এই খাতে বাজেট পাশ করতে গেলে জনগণের থেকেই সেই টাকা তুলতে হয়। ফলে কুকুরপ্রেম দেখাতে গিয়ে বেড়ে যায় আমার-আপনার চাল-ডাল-তেল-নুনের দাম। আমি আমার টাকা দিয়ে কুকুরপ্রেমের মত বিলাসবহুল কাজ করতে রাজি নই।
এজন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাস্তায় কুকুরের জনসংখ্যা না বৃদ্ধ করে ইউথোনাইজ (euthanize) পদ্ধতিতে চেতনাহীন করে নিধন করা হয়। এর পদ্ধতিতে কুকুরকে উচ্চমাত্রায় পেন্টোবারবিটাল ঔষধ প্রয়োগ করা হয়, যা কুকুরটিকে অনুভূতিহীন করে এবং এক বা দুই মিনিটের মধ্যে তার মস্তিষ্ক ও হৃদপিণ্ডের কার্যকরীতা বন্ধ করে দেয়। এটি কুকুর নিধনে সহজ ও স্বল্প খরচের পদ্ধতি। বাংলাদেশের সিটি কর্পোরেশনগুলো থেকেও খুব সহজেই এই কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব।
যেহেতু, বর্তমানে কুকুরপ্রেমীদের অপতৎপরতার কারণে কুকুর নিধন করা সম্ভব হচ্ছে না। জনগণের উচিত হবে, কুকুরপ্রেমীদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতি এলাকায় এলাকায় সোচ্চার হওয়া এবং সিটি কর্পোরেশনগুলোতে গিয়ে কুকুর নিধনের দাবী তোলা। জনগণ সোচ্চার হলে সিটি কর্পোরেশনগুলো পুনরায় কুকুর নিধনের কার্যক্রম শুরু করবে নিশ্চিত।