খেলাধূলা বনাম বাস্তবতা

খেলাধূলা বনাম বাস্তবতা

 খেলাধূলা বনাম বাস্তবতা

লেখা: মুহম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান

 বর্তমানে বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২৩ খেলা চলমান। অতি সম্প্রতি বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা সংক্রান্ত একটি সংবাদে আমার নজর আটকায়। খরবটি হলো- “পাকিস্তানী ক্রিকেটার ফখর প্রতিটি রানের জন্য পাচ্ছে ৮০০০ রুপি” (দৈনিক প্রথম আলো, ৫ নভেম্বর, ২০২৩)

 সংবাদটি দেখে আমার মাথায় চিন্তা আসলো, “আচ্ছা ! যেসব খেলোয়াড় খেলছে, তারা টাকা পাচ্ছে, কিন্তু যারা সেই খেলা দেখছে তারা কি পাচ্ছে ?”

 পরে হিসেব মিলিয়ে দেখলাম, যারা (পাবলিক) খেলা দেখছে তারা টাকা হারাচ্ছে, আর যারা খেলছে (খেলোয়াড়) তারা ঐ পাবলিকের টাকাই পাচ্ছে। কারণ খেলার মধ্যে অনেক কোম্পানি তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখায়। সেই বিজ্ঞাপন কোম্পানিগুলোই মূলত খেলোয়ারদের টাকা দেয়। আর যে টাকা দেয়, সেই টাকা আবার পণ্যের দাম বাড়িয়ে মানুষের কাছ থেকে উসুল করে নেয়। অর্থাৎ যারা খেলা দেখে ইচ্ছায় হোক আর অনচ্ছিায় হোক তাদের থেকে কোনভাবে টাকা নেয়া হয়, আর সেই টাকাই ঘুরিয়ে খেলোয়াড়দের দেয়া হয়।

 এ তো গেলো শুধু টাকার হিসেব। খেলা দেখতে গেলে সময় ব্যয় হয়। সময় অমূল্য সম্পদ, যে সময় একবার যায়, তা আর ফিরে আসে না। খেলা শব্দের কাছাকাছি বিশেষণ শব্দ হলো ‘খেলো’। অভিধানে খেলো শব্দের অর্থ হলো- নিকৃষ্ট; হীন; নীচ। সোজা ভাষায় খেলা হচ্ছে একটা অপ্রয়োজনীয় জিনিস, আর মানুষ সেই অপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য তার মহামূল্যবান প্রয়োজনীয় সময় নষ্ট করে ফেলে।

 মহান আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে বলেছেন, “আর আমি আসমানসমূহ, যমীন এবং এতদোভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তা খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। ” (সূরা আদ দুখান : আয়াত শরীফ ৩৮) অর্থাৎ আল্লাহ পাক উনার সৃষ্টির মধ্যে খেলা বা অপ্রয়োজন নেই, ঠিক তেমনি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষেরও উচিত নয়, তার জীবনটা খেলাচ্ছলে ব্যয় না করা।

 আসলে, আজকাল সাধারণ মানুষের মধ্যে খেলার ব্যাপক বিস্তার তো ঘটেছেই, উপরন্তু ধর্মীয় বক্তা, খতিবরা পর্যন্ত মাঠে গিয়ে খেলাধূলা করে। অনেক মাদ্রাসায় বিকেল বেলায় দেখা যায় ছাত্ররা খেলাধূলায় মত্ত। নাউযুবিল্লাহ।

 আসলে আগে মুসলমানরা এভাবে খেলাধূলার নামক অপ্রয়োজনীয় জিনিসে সময় ব্যয় করতো না। তারা অবসরে ঘোড়া দৌড়, তীর-তরবারি চালানো, যুদ্ধ প্রশিক্ষণে সময় ব্যয় করতো। আপনারা জানেন, সম্প্রতি ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ চলমান। ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের শিক্ষা ব্যবস্থা অনুযায়ী, সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের সেনা প্রশিক্ষণ নেয়া বাধ্যতামূলক। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী ইসরাইয়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী-র সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। কখন যদি যুদ্ধ লাগে, তবে তারা সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেখা যায়, এই যুদ্ধ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিটি ইসরাইলী শিশু ছোট বয়স থেকেই যুদ্ধ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের শত্রু সম্পর্কে ধারণা পায়। ফলে ‘শত্রুকে ধ্বংস করে বিশ্বজুড়ে ইহুদীবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে’ এই ধারণা প্রতিটি ইহুদী শিশুকে ছোটবেলা মন-মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের মধ্যে এই চর্চাটি নেই। বরং আমাদেরকে কত উপায়ে অপ্রয়োজনীয় খেলাধূলায় মত্ত থাকা যায়, সেই শিক্ষা দেয়া হয়। অথচ হাদিস শরীফে মুসলমানদের খেলাধূলা নয়, বরং যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী করা হয়েছে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “মানুষের প্রত্যেক খেলা-ধুলা বাতিল, তবে তীর নিক্ষেপ, ঘোড়া দৌড়ান এবং নিজ স্ত্রীর সাথে বিনোদন ব্যতীত।”(তিরমিযি, ইবনে মাজা, মুসনাদে আহমাদ এবং সহীহ ইবনে খোযাইমা)

 আসলে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণের বিষয়টি যে নেই তা নয়। আছে। এই দায়িত্বটা দেয়া আছে, সরকারের বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর অধিদপ্তরকে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সামরিক প্রতিক্ষণ দিয়ে দ্বিতীয় সারির প্রতিরক্ষা বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলাই হল বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি)-এর দায়িত্ব। কিন্তু এ বিষয়টি পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভূক্ত নয়, সামান্য কিছু শিক্ষার্থীকে বাছাই করে এ ট্রেনিং দেয়া হয়। কিন্তু সবাইকে এর সাথে সংযুক্ত করা হয় না। অপরদিকে বাংলাদেশে পাঠ্যবইয়ে ‘শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধূলা’ নামক বিষয়ের মাধ্যমে খেলাধূলাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং সেখানে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক নম্বরও সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে প্রতিটি শিক্ষার্থী বাধ্যতামূলক খেলাধূলায় সম্পৃক্ত হচ্ছে।

 আমার মনে হয়, বাংলাদেশের পাঠ্যবইয়েও যদি বিএনসিসির মত সামরিক প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত করা যায় এবং শিক্ষার্থীদের জন্য তা বাধ্যতামূলক বা তাত্ত্বিক-ব্যবহারিক নম্বর সংযুক্ত করা হয়, তবে আমাদের নতুন প্রজন্ম খেলাধূলা মত অপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে সরে বাস্তব কিছু শিখতে পারবে। তখন খেলায় হার-জিত-কে দুনিয়ার সব কিছু মনে করবে না। ক্রিকেট খেলাকে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা ক্রিকেট খেলোয়াড়দের মুক্তিযোদ্ধার সাথে বোকার মত তুলনা করবে না। খেলা আর বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারবে। একই সাথে, এর মাধ্যমে শত্রু সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা লাভ করতে পারবে এবং জাতির সামষ্টিক লক্ষ্য (collective Goal) কি সেটা কিছুটা হলেও বুঝতে পারবে। অর্থাৎ আমাদের নতুন প্রজন্মের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসবে, যার মাধ্যমে আমাদের পুরো জাতি এগিয়ে যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ব দরবারে শক্তির জানান দিবে। তাই আমাদের নতুন প্রজন্মকে খেলাধূলা থেকে বাস্তব জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসা খুব খুব দরকার।

Comments