ফেসবুক-ইউটিউবের যুগে কোন লেখা পড়তে কষ্ট হয় কেন?

ফেসবুক-ইউটিউবের যুগে কোন লেখা পড়তে কষ্ট হয় কেন?

 ফেসবুক-ইউটিউবের যুগে কোন লেখা পড়তে কষ্ট হয় কেন?

লেখা: মুহম্মদ রাফসানযানি

 বর্তমানে অনেকেই জানান, তার কোন লেখা পড়তে ইচ্ছা করে করে না। পড়ার বই বা পত্রিকার আর্টিকেল, এমনকি ডিজিটাল মাধ্যমের লেখাও নয়। সে ভিডিও’র মাধ্যমে জানতে ইচ্ছুক। কারণ ভিডিওর মাধ্যমে কষ্ট কম এবং সহজ হয়।

 মানুষের মধ্যে হঠাৎ এ ধরনের অভ্যাস তৈরী হওয়ার একটি বড় কারণ ইন্টারনেটে ইউটিউব বা ফেসবুকের ব্যবহার। মানুষ এখন ইউটিউব বা ফেসবুকে প্রচুর পরিমাণে ভিডিও কনটেন্ট দেখে। দ্রুত স্ক্রল করে এবং একটার পর একটা আসতে থাকে। মানুষ যেন আরো সংক্ষেপ ও কম কময়ে তা দেখতে পারে, এজন্য ফেসবুক ইউটিউব নিয়ে আসছে রিল বা শর্টসের মত সংক্ষিপ্ত ভিডিও ভার্সন। এই যে ভিডিও দেখার অভ্যাস এবং দ্রুত একটির পর একটি দেখা, এটি মানুষের আচরণে পরিবর্তন এনে ধৈর্য চ্যূতি ঘটাচ্ছে। সে একটি ভিডিওতেও বেশিক্ষণ মনোযোগ দিতে পারছে না, বরং অনেক ভিডিও দেখতে হবে এমন তাড়া অনুভব করছে, এটা এক ধরনের ধৈর্য্য চ্যুতির অভ্যাস। এই অভ্যাস তার ভেতর রয়ে যাচ্ছে। সে যেখানেই যাচ্ছে, সেই ধৈর্যের অভাব সে সর্বস্থানে অনুভাব করছে। সব কিছু দ্রুত কম কষ্টে চাচ্ছে। ফলে কোন স্থানেই মন বসাতে পারছে না।

 আসলে মানুষের ব্রেন হচ্ছে শরীরের মতই। একজন মানুষ যদি শারীরিরভাবে কঠোর পরিশ্রম করে, তবে সে কঠোর পরিশ্রমে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আবার কেউ যদি শরীরকে নরম কাজে ব্যবহার করে, তখন সে নরম কাজে অভ্যস্ত হয়। তাকে দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করানো যায় না।

 ঠিক একই রকম হচ্ছে আমাদের ব্রেন। আপনি তাকে দিয়ে যেমন কাজ করাবেন, সে তেমন কাজেই অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। আপনি যখন ভিডিও দেখছেন, তখন আপনার ব্রেন তথ্য পাচ্ছে সেটা ঠিক, কিন্তু সে চিন্তা করার ক্ষমতা হারাচ্ছে। মানে সে হয়ত তথ্য জমা (স্টোর) করছে, কিন্তু নিজ থেকে পরিশ্রম করছে না। সে হয়ত ভাবছে, আমি অনেক কিছু জানছি, মানে সে তথ্য পাচ্ছে, কিন্তু চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলছে, এটা একটা বড় সমস্যা।

 আসলে মানুষের মস্তিষ্ক বা ব্রেনের একটা বড় গুন হচ্ছে চিন্তা করার শক্তি। তথ্য জমা করাটাই সব না, বরং সেটা প্রসেসিং করা এবং প্রয়োজন মত ব্যবহার করা বড় গুন। একটা পেন ড্রাইভে অনেক তথ্য থাকে, কিন্তু সেই তথ্য সে প্রসেসিং করতে পারে না, মানে কাজে লাগাতে পারে না।

 কোন বই বা লেখা পড়লে মানুষ চিন্তা করার সময় ও সুযোগ পায়। সে নিজের ব্রেনের ভেতর লেখাগুলো কল্পনায় দৃশ্যায়ন (ভিজুয়ালাইজেশন) করে। এতে তার ব্রেন পরিশ্রম করে এবং তার কার্যক্ষমতা ও সৃজনশীলতা (ক্রিয়েটিভিটি) বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে ভিডিওতে কোন বিষয়ের দৃশ্যায়ন (ভিজুয়ালাইজেশন) করাই থাকে। ফলে তার ব্রেনকে তা কল্পনায় দৃশ্যায়ন করতে আলাদা পরিশ্রম করতে হয় না। ব্রেন পরিশ্রম না করায়, মানুষ আরাম অনুভব করে। ভাবে তার কষ্ট কম হচ্ছে। কিন্তু তার ব্রেন বসে থাকতে থাকতে যে অলস হচ্ছে, চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলছে সেটা সে বুঝতে পারে না।

 আবার যারা ভিডিও কনটেন্টগুলো তৈরী করে, তাদের উদ্দেশ্যেই থাকে, অধিক মানুষকে হিট করানো। অধিক মানুষ দেখলে টিআরপি (রেটিং পয়েন্ট) বাড়বে, আর টিআরপি বাড়লে তার ইনকামও বাড়বে। কিন্তু অধিক মানুষের উপযোগী ভিডিও বানাতে গিয়ে সে কোন ঘটনার ভেতরে ঢুকতে পারে না, ভাসা ভাসা জ্ঞান দেয়। ফলে ভিডিও দেখে যে আপনি কোন বিষয়ের ছায়া (শ্যাডো) তথ্য পেতে পারেন, কিন্তু পুরো বা বাস্তব ঘটনা জানতে পারবেন না। তাছাড়া লিখে যত কিছু বলা যায়, ভিডিওতে তত কিছু দেখা যায় না। একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র (রিসার্চ পেপার) কি কখন ভিডিওতে দৃশ্যায়ন করা সম্ভব ? কখনই না। এছাড়া তথ্য প্রকাশে খরচও একটি বিষয়। লেখার মাধ্যমে যত কম খরচে একটি তথ্য প্রকাশ করা যায়, সেটা ভিডিও (দৃশ্যায়ন) এর মাধ্যমে প্রকাশ করতে গেলে বহু খরচ হবে, অনেক ক্ষেত্রে তা সম্ভবও নয়।

 সোজা ভাষায়, ভিডিও দেখার কারণে মানুষের চিন্তাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে, যা বর্তমানে একটি বড় সমস্যা। অনেকে ভাবছে, তরুণ প্রজন্ম ভিডিও দেখে উন্নত বা আধুনিক হচ্ছে। কিন্তু না। ভিডিও দেখার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মে পশ্চিমাকরণ (ওয়েস্টানাইজ) হচ্ছে। তারা ইউরোপ-আমেরিকার অনুকরণ করছে মাত্র, কিন্তু নিজের চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু তৈরী করতে পারছে না। শারীরিক দাসত্বের মত এটাও এক ধরনের দাসত্ব, যাকে বলে- মানসিক দাসত্ব। আমরা নিজের অজান্তেই সেই দাসত্ব বরণ করছি। আবার মানব জীবনে ধৈর্য্য অতীব প্রয়োজনীয় জিনিস। ধৈর্য্য না থাকলে মানুষ কোন যায়গায় স্থায়ী হতে পারে না। আর কোথাও স্থায়ী হতে না পারলে, সে উন্নতি করা দূরের কথা, বার বার জীবনে ধাক্কা খায়। বর্তমানে ফেসবুক বা ইউটেউবের ভিডিও দেখা বা স্ক্রলের অভ্যাসে মানুষের ধৈর্য্যহীনতা ব্যাপকহারে বাড়ছে। এভাবে ধৈর্যহীন প্রজন্ম বাড়তে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সমাজ কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করবো।

 সুতরাং আমরা যদি ধৈর্য্যশীল, চিন্তাশীল ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পন্ন প্রজন্ম চাই, তবে আমাদের ভিডিও দেখা বাদ দিতে হবে। লেখা পড়ার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, তবেই আমরা ভবিষ্যতে ভালো কিছু আশা করতে পারবো।

Comments