পবিত্র মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফ কেন শুধু সৌদি আরবের খিদমত জিম্মায় থাকবে ?

পবিত্র মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফ কেন শুধু সৌদি আরবের খিদমত জিম্মায় থাকবে ?

পবিত্র মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফ কেন শুধু সৌদি আরবের খিদমত জিম্মায় থাকবে ?

-মুহম্মদ গোলাম সামদানি

 পবিত্র মক্কা শরীফ ও পবিত্র মদীনা শরীফ সকল মুসলমানের দ্বীনি কেন্দ্র। সারা বিশ্ব থেকে মুসলমানরা সেই দু্ই পবিত্র মসজিদ জিয়ারতে যান। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই দুই পবিত্র মসজিদ কেন শুধু সৌদি আরবের শাসকের খিদমত জিম্মায় থাকবে ? পবিত্র মসজিদের হক তো সবার, কেন শুধু একটি মাত্র শাসক পরিবার তা কুক্ষিগত করে রাখবে ?

 ইতিহাস বলে, সৌদ পরিবারে আদি বাস কখনই মক্কা শরীফ বা মদীনা শরীফ নয়, এদের আদিভূমি নজদের দিরিয়া অঞ্চলে। পবিত্র মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফে নিয়মিত আক্রমণ, ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটতরাজ চালানো এই মরুদস্যু পরিবারের পুরাতন অভ্যাস। এর আগেও ১৮০৩-০৪ সালে এরা পবিত্র মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বহু মুসলিমকে হত্যা করে। সাহাবীগণের পবিত্র মাজার শরীফ গুড়িয়ে দেয়। এমনকি পবিত্র রওজা শরীফ উনার ছায়াদানকারী মিম্বরগুলোও এরা ভেঙে ফেলে! নাউযুবিল্লাহ। ১৮১৮ সালে উসমানীয় খলিফা এসব সৌদ কুলাঙ্গারদের গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো।

 ১৯২৫ সালে আবারও আরবের হেজাজ দখল করে নেয় সৌদ পরিবার। এরপর নিজেদের পরিবারের নাম পবিত্র হেজাজের নামের আগে জুড়ে দেয়, ফলে হেজাজ হয়ে যায় সৌদি আরব। ক্ষমতা দখলের পর তারা পবিত্র জান্নাতুল বাকি শরীফে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হযরত আহলে বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম এবং হযরত সাহাবীগণের মাজার শরীফের গম্বুজগুলো বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়। নাউযুবিল্লাহ। আজ থেকে ১০০ বছর আগে পবিত্র জান্নাতুল বাকী শরীফের যে দৃশ্য পাওয়া যায়, সেখানে মাজার শরীফের সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়।

 মূলত, এমন মানুষের খিদমত জিম্মায় পবিত্র মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফ থাকা উচিত, যারা এই দুই পবিত্র মসজিদের সম্মান মর্যাদা অনুসারে আদব বজায় রাখতে পারবে। কিন্তু সৌদ পরিবারের যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তা পবিত্র দুই মসজিদের সাথে চরম বেয়দাবী এবং পবিত্র হারাম শরীফে রক্তপাত ও লুটতরজের ইতিহাস। সে অনুসারে তারা কিভাবে এই দুই পবিত্র স্থানের খিদমতের জিম্মা লাভ করতে পারে?

 শুধু এতটুকুই নয়, সৌদি আরবের ক্ষমতা নিয়ে সৌদ পরিবারের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব হয়, তার প্রভাবে হাজীদেরকেও জীবন দিতে হয়। ২০১৫ সালে বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজের স্থলে সালমান বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতায় আসলে তাদের পরিবারের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান হয়। সেই বছরই মসজিদ আল হারামে রহস্যজনকভাবে ক্রেন ভেঙ্গে পড়লে ১১৮ জন হাজী শহীদ হন এবং ৩৯৪ জন আহত হন। এর মাত্র ২ সপ্তাহ পর হজ্জ চলাকালে পবিত্র মক্কায় যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমানের গাড়ি বহরের কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বন্ধ হয়ে যায়, এতে ভীড়ের চাপে পদদলিত হয়ে অসংখ্য হাজী শহীদ হোন। সৌদি সরকারী হিসেবে হাজীর মৃত্যুর সংখ্যা ৭৬৯ জন দাবী করা হলেও, এপি (অ্যাসোসিয়েট প্রেস) সেই সংখ্যা ২৪১১ জন বলে হিসেব প্রকাশ করে। এতে স্পষ্ট হয়, কথিত খাদেম দাবীকরা সৌদ পরিবারের হাতে সম্মানিত হাজীরা মোটেও নিরাপদ নন।

 সৌদি সরকার হজ্জ বা ওমরাহ করার জন্য প্রতি হাজী থেকে একটি নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নেয়। সম্প্রতি এ অর্থের পরিমাণ তারা বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতি বছর যে পরিমাণ লোক হজ্জ করে, তাতে হজ্জ ও ওমরাহকারীদের থেকে বিপুল পরিমাণ লাভবান হয় সৌদি সরকার। সৌদি সরকার হাজীদের থেকে অর্থ ছাড়া দিতে চায় না, এতে হাজীদের অনেক কষ্ট হয়। অথচ তারাই খেলাধূলা, নাইটক্লাব, সিনেমা হল আর কনসার্টের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে, নেইমার-রোনালদো মত খেলোয়াড়দের পেছনে বস্তা বস্তা টাকা অপচয় করে, যা সত্যিই দৃষ্টিকটু।

 আবার সৌদি ভিশন-২০৩০ এর অংশ হিসেবে দেশটি তাবুক অঞ্চলে ‘নিওম সিটি’ নামক একটি শহর বানানো শুরু করেছে। দাবী করা হচ্ছে, নিওম সিটি হচ্ছে অত্যাধুনিক ভবিষ্যত শহর, যা প্রযুক্তির দিক থেকে হবে আমেরিকার সিলিকন ভ্যালির মত, বিনোদনের দিক থেকে হবে আমেরিকার হলিউড শহরের মত আর অবসর যাপনের জন্য হবে ফ্রান্সের সমুদ্র সৈকতের মত। যেখানে সৌদির চলমান আইনে কোন হস্তক্ষেপ থাকবে না, যে কেউ ইচ্ছা মত কাজ করতে পারবে। নাউযুবিল্লাহ। মূলত ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বাজেটের এই নিওম সিটি বানানোর একটি বড় অংশের দায়িত্ব পেয়েছে ইসরাইল। ইসরাইল যেন নিওম সিটিতে ঠিক মত কাজ করতে পারে, এজন্য ইসরাইলকে সম্প্রতি স্বীকৃতি দিতে উদ্দত হয় সৌদি আরব। কিন্তু সৌদি ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম নষ্ট হবে, এ কারণে তারা সৌদিকে থামাতে গত ৭ই অক্টোবর, ২০২৩ তারিখ ইসরাইলে হামলা করে বসে হামাস। সেখান থেকেই সাম্প্রতিক ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতের সূচনা।

 লক্ষ্য করুণ, হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেনঃ আমি ইহুদী ও নাসারাদের আরব উপদ্বীপ হতে অবশ্যই বহিষ্কার করব। মুসলিম ব্যতীত অন্য কাউকে সেখানে বসবাস করতে দিব না। [সহীহ আবূ দাউদ, মুসলিম]

 আখেরী নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সেই পবিত্র আদেশ হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু নিজ খিলাফত আমলে বাস্তবায়ন করেন।

 অথচ সৌদ পরিবার সেই আদেশ লঙ্ঘন করে কাফির-মুশরিক, ইহুদী-খ্রিস্টানদের নিয়ে আসছে আরব উপদ্বীপে এবং সেখানে তাদের অবাধে হারাম কাজ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। সৌদ পরিবার যদি পবিত্র স্থানের হুরমত বা সম্মান নাই রক্ষা করতে পারে, বরং খিয়ানত করে, তবে তাদের জিম্মায় পবিত্র স্থান রাখা কতটুকু যুক্তিযুক্ত ?

 উল্লেখ্য, বর্তমানে সৌদি বাদশাহ সালমানের নেতৃত্বে একটি কাউন্সিল দুই পবিত্র মসজিদের দায়িত্ব পালন পালন করছে। কিন্তু এই দায়িত্ব কেন সৌদি বাদশাহ বা তার অধিনস্ত কাউন্সিলের একার থাকবে ? মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফ বিশ্বের সকল মুসলিমের অধিকার। মুসলিম দেশগুলোর সমন্বিত কোন কাউন্সিল দুই পবিত্র মসজিদের খিদমতের আঞ্জাম দিতে পারে। কিন্তু একক ভাবে সৌদি সরকার কিংবা বাদশাহের কাউন্সিল তার দখল নিয়ে রাখতে পারে না।

 আরো উল্লেখ্য, আগে মুসলিম জাহানের খলিফা বা সুলতান থাকতেন দুই পবিত্র মসজিদের প্রধান খিদমতের দায়িত্বে। কিন্তু সৌদি শাসক তো খলিফা নয়, সে একটা মাত্র দেশের রাজা। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি এ পবিত্র পদে থাকলে সেই পদটি রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হতে পারে, যা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য ভয়ঙ্কর। তাই দুই পবিত্র মসজিদের খাদেমের পদটি অবশ্যই রাজনীতির উপরে রাখা উচিত।

 সুতরাং সৌদি শাসক কর্তৃক এককভাবে পবিত্র দুই পবিত্র মসজিদের দায়িত্ব ধরে রাখা কখনই ন্যায্য হতে পারে না। তাই দুই পবিত্র মসজিদের খিদমতের জিম্মা পৃথিবীর সকল মুসলমানদের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন কাউন্সিলকেই দিতে হবে, এমন দাবী তোলা পৃথিবীর সকল মুসলমানের দায়িত্ব হয়ে দাড়িয়েছে।

Comments