গরীবের পাতে ইলিশ ফিরবে কবে ?

Comments · 2111 Views

গরীবের পাতে ইলিশ ফিরবে কবে ?

 

গরীবের পাতে ইলিশ ফিরবে কবে ?

লেখা: এস হাবীব

 কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে এক শিশুকে একাধিকবার জিজ্ঞেস করা হয়, ‘বাংলাদেশের জাতীয় মাছের নাম কি ?’ উত্তরে সে প্রতিবারই বলে, ‘বাংলাদেশের জাতীয় মাছের নাম পাঙ্গাস। ’ জাতীয় মাছ ইলিশের অতি উচ্চমূল্যে তার দেখা যে গরীব বা মধ্যবিত্তরা পাচ্ছে না, সেটাই যেন অবুঝ শিশুর কথায় ফুটে উঠে।

আসলে ইলিশকে যখন জাতীয় মাছ করা হয়, তখন ইলিশের এত দাম ছিলো না। আজ থেকে কয়েক দশক আগেও গরীবের পাতে ইলিশের দেখা মিলতো। কিন্তু গত ১ দশকে ইলিশের সংখ্যা বৃদ্ধির নামে অনেক নিয়ম কানুন চালু হয়।  বিশেষ করে, গত কয়েক বছর যাবত ইলিশের সংখ্যা বৃদ্ধির নামে নদী-সমুদ্রে মাঝে মধ্যেই মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়।  বর্তমানে বছরে ৩ বার মানে ১২ মাসের মধ্যে ৫ মাসই নদী বা সমুদ্রে ইলিশসহ সকল মাছ ধরা বন্ধ থাকে।

১) ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত - ২ মাস। নদীতে ইলিশসহ সবধরনের মাছ ধরা বন্ধ।

২) ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই - ৬৫ দিন। সমুদ্রে ইলিশসহ সকল মাছ বন্ধ ধরা বন্ধ।

৩) ১১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর ২২ দিন। নদী-সমুদ্রে ইলিশসহ সব মাছ ধরা বন্ধ।

প্রশ্ন হচ্ছে, গত কয়েক বছর যাবত নদ নদী ও সমুদ্রে প্রায় অর্ধেক সময় মাছ ধরা বন্ধ করে মাছের প্রাপ্তি কী বেড়েছে?

হয়ত বলতে পারেন, কাগজে কলমে তো বেড়েছে।

কিন্তু আমি বলবো- কাজীর গরু কিতাবে থাকলে তো আর হবে না, গোয়ালে থাকতে হবে।

নদী সমুদ্রে মাছ ধরা বন্ধ করে যদি সত্যি মাছের পরিমাণ বাড়তো, তবে সেই মাছ মধ্যবিত্তের পাত উপচে গরীবের পাতে আসতো। কিন্তু মাছ যখন ধনীর পাত ছেড়ে আর বের হচ্ছে না, তখন বুঝতে হবে, এই সব আজগুবি নিয়ম করে মাছের প্রাপ্তি বৃদ্ধি নয়, বরং কমে গেছে।

লক্ষ্য করুণ-

 প্রথমত, বাজারে গত জুলাই থেকে ৩ মাস যাবত ইলিশ এসেছে, কিন্তু গত ১১ই অক্টোবর ২০২৩ তারিখে সেই ইলিশ ধরা বন্ধ করে দেয়া হলো ২২ দিনের জন্য। বলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে মা ইলিশ রক্ষা পাবে, ইলিশ ডিম পাড়বে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইলিশ কি নির্ধারিত তারিখ দেখে ডিম পাড়ে? যারা গত ৩ মাস ইলিশ কিনেছে তারা জানে, অধিকাংশ ইলিশের পেটে ডিম ছিলো। মা ইলিশ রক্ষা করা যদি মূল উদ্দেশ্য হয়, তবে গত ৩ মাস যে হারে মা ইলিশ নিধন চলেছে তাতে তো ইলিশের বংশ নির্বংশ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তা তো হয়নি।

 

দ্বিতীয়ত, ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞার পর জুলাই মাসে যখন ইলিশ আহরণ শুরু হয়, তখন প্রথম প্রথম ইলিশ পাওয়া যায় না, কিন্তু কয়েকদিন পর ইলিশ পাওয়া শুরু হয়। এবং ধীরে ধীরে তার পরিমাণ বাড়তে থাকে। কিন্তু তাদের সূত্র অনুসারে ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকার পর তো নদী বা সমুদ্রে মাছ গিজগিজ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তা তো হয় না। কিন্তু যখনই জাল ফেলে মাছ ধরা শুরু হয়, তখন ধীরে ধীরে কেন মাছ প্রাপ্তি বৃদ্ধি পায়। এর ব্যাখ্যা কি?

এর ব্যাখ্যাটা আমার কাছে অনেকটা কুয়ার পানির মত মনে হয়। কুয়া থেকে যত পানি তুলবেন, তত চারপাশ থেকে পানি এসে কুয়াকে পুনরায় ভরে দিবে। অর্থাৎ কুয়াতে পানি তুলে আপনি যে খালি জায়গা তৈরী করছেন, সেখানে চারপাশ থেকে পানি এসে জমা হচ্ছে। আরেকটি উদাহরণ দিলে বুঝতে হবে সহজ হবে, কোন এক এলাকায় যদি কুকুর থাকে, তবে আরেক এলাকা কুকুর সেখানে আসতে পারে না। ঘেউ ঘেউ শুরু করে। অর্থাৎ কোন এলাকায় যখন ইলিশ বা অন্য কোন মাছের ঝাক বিচরণ করে, তখন ঐ এলাকায় নতুন ঝাক আসে না। কিন্তু যখন আপনি জাল দিয়ে মাছ তুলে নিচ্ছেন, তখন মাছের ভ্যাকুয়াম তৈরী হচ্ছে, আর তারা ঝাকে ঝাকে সেই ভ্যাকুয়ামে আসার জন্য আসছে, পুরো ভারত মহাসাগর থেকে সেই ঝাকের মুখ আমাদের সীমানায় আসছে। আর আমরা সেই মাছগুলো জাল দিয়ে তুলে নিচ্ছি। যদি আমরা সেখান থেকে মাছ না নেই, তবে আমাদের সীমানা মাছের ঝাক দিয়ে পূর্ণ হয়ে যায়, ফলে নতুন মাছ সেখানে আসে না। নতুন মাছ মুখ ঘুড়িয়ে অন্য এলাকায় চলে যায়।

 সম্ভবত, বাংলাদেশের মৎস নীতি নির্ধারকরা ভাবেন, নদী সমুদ্র হচ্ছে অনেকটা পুকুরের মত।  পুকুরে যেমন মা মাছ না ধরে ডিম পাড়তে দিলে মাছের সংখ্যা বাড়ে, ঠিক তেমন নদী সমুদ্রেও হয়। কিন্তু পুকুর যে একটি নির্দ্দিষ্ট বদ্ধ স্থান, অপরদিকে নদী-সমুদ্র মিলে অসীম পানিরাশি, যা দেশ ছাড়িয়ে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশেও সংযুক্ত হয়েছে, তারা হয়ত সেটা ভুলে যান। বিশেষজ্ঞরা ধরেই নিচ্ছেন, আমাদের সীমানায় সীমিত কিছু অংশেই ইলিশ ডিম পাড়ছে, কিন্তু আমাদের সীমানার বাইরেও ইলিশের বংশবিস্তারের এলাকা থাকতে পারে, এটা তারা অস্বীকার করবেন কিভাবে ? সেখান থেকেও তো আমরা ইলিশ পেতে পারি।  মূলতঃ আমরা ইলিশ ধরা বন্ধ রেখে মস্ত ভুল করছি, বঞ্চিত হচ্ছি বিশাল ইলিশ প্রাপ্তি থেকে।

 তাছাড়া আমরা মা ইলিশ না খেলেই ইলিশের সংখ্যা বাড়বে, এটাও আসলে ভুল ধারণা। কারণ পানির নিচে একটা বাস্তুসংস্থান আছে। সেখানে এক প্রাণী অপর প্রাণীর খাবার। একটি ইলিশ ২৫-৩০ লক্ষ ডিম পাড়ে। এই ডিমও অন্য প্রাণী খায়। একইসাথে ইলিশের পোনা এমনকি বড় ইলিশও বড় কোন প্রাণীর খাবার হতে পারে। সুতরাং আমরা যদি ইলিশ না খাই, তবে সেই ইলিশ যে আরেক প্রাণীর খাবার হবে না, সেটা আমরা নিশ্চিত হলাম কিভাবে ? মূলত মহান আল্লাহ পাক এভাবেই প্রকৃতিতে ভারসাম্য রক্ষা করেন। যদি এভাবে ভারসাম্য রক্ষা না হতো, তবে কোন একটি প্রাণীর আধিক্যে পুরো পরিবেশ নষ্ট হয়ে পড়তো।

 তবে বছরে প্রায় ৫ মাস নদী-সমুদ্রে মাছ ধরা বন্ধ করে ইলিশসহ অনেক দেশী মাছ এখন ধনী শ্রেণীর খাবারে পরিণত হয়েছে। মধ্যবিত্ত বা গরীবরা আর দেশী মাছের নাগাল আর পায় না।  এক্ষেত্রে ৫ মাস মাছ ধরা বন্ধ রেখে একদিকে  যেমন মৎসজীবিদের আর্থিক চাহিদা বৃদ্ধি করা হয়, ঠিক তেমনি বড় লোকের রুচির এক ঘেয়েমিও কাটানো হয়।  ফলে মাছ ধরা বন্ধ খুললে মৎসজীবিরা মাছের দাম বৃদ্ধি করে ক্ষতি পুষানোর চেষ্টা করে, আর বড় লোক রুচির এক ঘেয়েমি কাটিয়ে বেশি টাকা দিয়ে সেই মাছ কিনে একাই তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়।

মনে করে দেখুন, জুলাই মাসে যখন ইলিশ ধরা শুরু হলো, তখন ১ কেজি ওজনের ইলিশ ১৮শ’ টাকাতে পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। দাম বেশি হলেও সমস্যা নেই, ধনী শ্রেণী হালিতে হালিতে ইলিশ কিনে ডিপফ্রিজ ভরে ফেলে। কিন্তু এক খাবারের রুচি তো বেশি দিন থাকে না। বড় লোকে রুচি পড়াতে কেজির ইলিশ ১৪শ’, ১২শ’, ১ হাজার করে ৭-৮শ’ টাকায় নেমে আসলো। এই মাছ ধরাটা যদি আর ১ মাস থাকতো, তবে ইলিশের দাম নিশ্চিত কেজি ৫শ’তে নেমে আসতো, ফলে গরীব-মধ্যবিত্ত কিছুটা হলেও ইলিশের দেখা পেতো। কিন্তু তার আগেই বন্ধ করে দেয়া হলো ইলিশ ধরা। আর এতে আমাদের সীমানায় ইলিশ পূর্ণ হয়ে গেলে নতুন ইলিশের ঝাক আমাদের দিকে আসবে না, অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলবে। ফলে ২২ দিন পর নিষেধাজ্ঞা খুলে দিলেও খুব একটা ইলিশ আর পাওয়া যাবে না।

 আসলে বর্তমানে নিয়ম আর আইনগুলো এমনভাবে হয়, যেখানে ধনী আর কর্পোরেটরা লাভবান হয়। গরীব আর মধ্যবিত্তের পেটে জুটে না কিছু।  সমুদ্র বা নদীতে বছরে ৫ মাস মাছ ধরা বন্ধ করে সেই বিষয়টি কিন্তু ঘটছে। ইলিশসহ নদীর দেশী মাছগুলো ধনীর পাতে চলে গেছে, গরীব আর মধ্যবিত্তের পাতে আর তাদের দেখা মিলছে না। 

 

Comments