তরুণরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে ইউরোপ-কানাডায়, কিন্তু সেখানে কেমন অবস্থা?
দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিকাংশ শিক্ষিত তরুণ দেশ ছাড়তে আগ্রহী। তারা ভাবছে, দেশে সুযোগ নেই, বিদেশ গেলে হয়ত কিছু একটা হবে। সে আশায় আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, ইতালি, ফিনল্যান্ড, পতুর্গালসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তাদের ধারণা, একবার সেখানে যেতে পারলেই বোধ হয় ভালো ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তাদের এ চিন্তার সাথে তাল মিলিয়ে দালালরাও সাজিয়েছে নিত্য নতুন পসরা। দালালদের চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে তাই ২০-৩০ লক্ষ টাকা খরচ করতে দ্বিধা করছে না মানুষ। অনেকে জমি বিক্রি করে কিংবা ধার-দেনা করে চলে যেতে চায় বিদেশে। কিন্তু সেসব দেশে কি অবস্থা চলছে, সে সম্পর্কে না জেনেই নিয়ে ফেলেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। আর সে ভুলেই সম্মুক্ষীন হোন জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে।
ঘটনা-১ :
১৫ লাখ টাকা ঋণ করে ইতালি গিয়ে ৭ মাস বেকার, অতঃপর আত্মহত্যা
সুদে ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে ১৫ লাখ ঋণ করে গত বছর ইতালিতে গিয়েছিলেন কুমিল্লার যুবক সুমন মিয়া (২৫)। গত বুধবার রোমে একটি গির্জার পেছন থেকে তাঁর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে স্থানীয় পুলিশ। দূতাবাস ও পুলিশের পক্ষ থেকে পরিবারকে জানানো হয়, সুমন আত্মহত্যা করেছেন। সুমনের বড় ভাই রুবেল জানান, গত বছর এপ্রিল মাসে রোমানিয়া এবং জুন মাসে ইতালিতে যান সুমন। ইতালি যেতে ১৫ লাখ টাকার মধ্যে ১০ লাখ টাকা ছিল সুদের দেওয়ার শর্তে ঋণ আর বাকি টাকা ছিল আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করা। সে কোনো কাজ না পাওয়ায় টাকা পাঠাতে পারেনি। রুবেল বলেন, ‘আমার ভাইয়ের বিদেশ যাওয়ার জন্য ১৫ লাখ টাকা পুরোটাই ঋণের। এর মধ্যে এক বিঘা জমি বিক্রি করে ৪ লাখ টাকা পরিশোধ করছি। আমার ভাইয়ের মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না। কীভাবে তার এই ঋণ শোধ করব সেটা নিয়ে আমরা পুরো পরিবার চিন্তায় আছি।’ এ ঘটনায় ইতালিপ্রবাসী মুরাদ মহিবুর নামে কুমিল্লার এক ব্যক্তি ফেসবুকে পোস্ট করেন, ‘সুমন মিয়া সাত মাস আগে ইতালির রোম শহরে এসেছেন। মাত্র ২৫ বছরের ওই যুবক ইতালিতে এসেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ সাত মাস বেকার থেকে কোনো কাজ না পেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছেন।’ (তথ্যসূত্র: আজকের পত্রিকা, ২৮ জানুয়ারি ২০২৪)
ঘটনা-২ :
কানাডা থেকে রাশেদ দেশে ফিরলেন লাশ হয়ে
কানাডায় আসা রাশেদ তানভীরের লাশ স্থানীয় সময় ২২ নভেম্বর টার্কিশ এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। গত ৫ সেপ্টেম্বর তানভির (২৮) নামের এই যুবক ১৯ লাখ টাকা খরচ করে ভিজিট ভিসায় এসে টরন্টোতে এ্যাসাইলাম নেয়। সে থাকতো বাংলা টাউনের ডেনফোর্থ এলাকার থায়রা এভিনিউতে। বিগত আড়াই মাসে অনেকের মতো নানান সংকটে সে হতাশ হয়ে পড়ে এবং গত ১০ নভেম্বর হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। জানা গেছে, তানভীরের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনিতে। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে তিনি। ঢাকা কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে কানাডা যান। তবে স্বপ্ন পুরণ হলো না তার। (তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক: ২৩ নভেম্বর ২০২৩)
ঘটনা-৩
বর্তমানে ফিনল্যান্ডের অবস্থা খুব খারাপ
খারাপ কেন বললাম কারণ যারাই যাচ্ছে জব পেতে ৬-৮ মাস অপেক্ষা করা লাগতেছে। ফিনল্যান্ডের গ্রুপ গুলোর পোস্ট দেখলেই খারাপ লাগে। অনেকে টাকা ধার-দেনা করে চলে আসে। চিন্তা করে একবার ইউরোপ গেলেই হলো, বাকিটা দেখা যাবে। ব্যাপারটা এত সহজ না। এখানে প্রতি মাসে থাকা-খাওয়া বাবদ আপনার ৫০-৮০ হাজার টাকার মত খরচ হবে। জব না করে কারোরই ৬-৮ মাস বসে খাওয়া সম্ভব না। বিশেষ করে যারা টাকা ধার-দেনা করে এসেছেন। বর্তমানে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী জব লেস। (ফেসবুক স্ট্যাটাস, মোহাইমিনুল ইসলাম, ৮ অক্টোবর, ২০২৩)
ঘটনা-৪
যুক্তরাজ্য : ব্যয় নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে প্রবাসীরা
মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি তেলসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব, বেকারত্ব- সব মিলিয়ে যুক্তরাজ্যে ভালো নেই বাংলাদেশিরা। এ কমিউনিটির প্রায় ১২ লাখ মানুষের বেশিরভাগ এখন বেড়ে যাওয়া ব্যয় নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছেন। গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে কয়েকগুণ। মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাড়ির ব্যাংক মর্টগেজের মাসিক কিস্তি দ্বিগুণ হয়েছে অনেকের। গত দুই বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। পুরোনো বাংলাদেশিরাই যেখানে হিমশিম খাচ্ছেন সেখানে গত তিন বছরে স্টুডেন্ট ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট ও কেয়ার ভিসায় আসা বাংলাদেশিরা পার করছেন চরম দুঃসময়। বিশেষ করে লন্ডনে আবাসন সংকটে নাকাল কর্মহীন বেকার অবস্থায় বহু বাংলাদেশি। অনেকের থাকার জায়গা নেই। (বাংলা ট্রিবিউন, ২৩ অক্টোবর ২০২৩)
ঘটনা-৫
লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশী সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার তুষার গত ৩রা অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে এক পোস্টে জানান, তার একজন বন্ধু দালালদের ক্ষপ্পরে পড়ে বাংলাদেশের ভালো চাকুরী ছেড়ে লন্ডনে এসে বিপদে পড়ে গেছে। বাংলাদেশে তার বন্ধু খুব আরামের চাকুরী করতো, কিন্তু লন্ডনে এসে কোন চাকুরী পান না। খুব কষ্ট করে একটা চাকুরী পেয়েছেন, তবুও সেটা হচ্ছে থালা বাসন মাজার কাজ। তার বন্ধু বলছে, আমার জন্য তো নিজের দেশই ভালো ছিলো। যে দালালের মাধ্যমে আসছি, সে আমাকে বুঝিয়েছিলো, তুমি তো শিক্ষিত মানুষ, বাংলাদেশে ভালো চাকুরী করতে, সুতরাং লন্ডনেও ভালো কাজ পাবে। কিন্তু লন্ডনে এসে দেখে, বাংলাদেশের পড়ালেখা বা চাকুরীর যোগ্যতা কোন কিছুরই সেখানে দাম নাই। কিন্তু তার পক্ষে দেশের ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়, কারণ ২০-২৫ লক্ষ টাকা ঋণ করে এসেছে। তুষার আরেক পরিচিত ব্যক্তির কথা তুলে আনে, তুষার বলে- ভাই থালা বাসন মাজতে মাজতে এমন অবস্থা, দম চলে যাচ্ছে, একদিন থালা-বাসন মাজার কষ্ট ভুলতে ৩ দিন পর্যন্ত ব্যথার ট্যাবলেট খেতে হয়।
ঘটনা-৬
ট্যুর এশিয়ার সিইও খালেদ সাইফুল্লাহ ২৯ জানুয়ারী, ২০২৪ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “দালালদের প্ররোচনায় পড়ে সেটেল হওয়ার উদ্দেশ্যে যারা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ভিজিট ভিসা কিংবা কৃষি ভিসার মত সিজনাল ভিসায় কানাডা কিংবা ইউরোপ পাড়ি জমাচ্ছেন তারা জেনে অথবা না জেনে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছেন। এদের অনেকেই আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবে কিংবা ধুকে ধুকে মরবে। কারণ বর্তমান বাস্তবতা খুবই ভয়াবহ।
এজন্য বাংলাদেশী শিক্ষিত তরুণ সমাজকে বলবো, দালালদের চটকদার কথা শুনে ইউরোপ-আমেরিকায় যাওয়ার জন্য ঝাঁপ দিবেন না। বিদেশে যাওয়ার জন্য যে অর্থ খরচ করবেন, কিংবা বিদেশে গিয়ে যে পরিশ্রম করার কথা চিন্তা করছেন, সেই অর্থ ও পরিশ্রম দিয়ে দেশেই কিছু চেষ্টা করুণ, প্রবাস জীবনের থেকে বহুগুন ভালো থাকতে পারবেন ইনশাল্লাহ।